ঢাকা, ১৩ মার্চ ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ রমজান ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

এ কেমন বাটপারি!

সাজ্জাদ হোসেন
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবারmzamin

জুলাই অভ্যুত্থানে চরম বর্বরতার শিকার হয়েছিলেন বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর বুলেটের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলে জীবন দিয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ। আহত হয়েছেন ২২ হাজারের বেশি মানুষ। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের সহায়তায় গড়ে তোলা হয়েছে জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশন। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এই ফাউন্ডেশন থেকে শহীদ পরিবারকে অর্থ সহায়তা দেয়া হচ্ছে একইসঙ্গে আহতদের চিকিৎসা খরচ ও সহায়তা দেয়া হচ্ছে। মানবিক এই কাজের প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। এ পর্যন্ত অনেকে এভাবে তর্থ হাতিয়ে নিয়েছে যাদের অন্তত ৫০ জন ভুয়া তথ্য দিয়ে ফাউন্ডেশন থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার তথ্য মিলেছে। যাদের শনাক্ত করে ইতিমধ্যে অর্থ ফেরত চাওয়া হয়েছে। প্রতারণার অভিযোগে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। যাদের ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। বাড়িতে মারামারি করে আহত হওয়া, স্বামী-স্ত্রীর মারামারিতে আহত হয়েও ফাউন্ডেশন থেকে সাহায্য নেয়ার পর বিষয়টি ধরা পড়েছে ফাউন্ডেশনের যাচাইয়ে। 

নয়ন শিকদার নামের এক ব্যক্তি শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট কমে যাওয়ার কারণে এক সময় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনেও তাই লেখা ছিল। কিন্তু শরীরের বিভিন্নস্থানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে, ফটোশপের মাধমে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন এমন ছবি তৈরি করে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জুলাই ফাউন্ডেশনে আহতদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তের আবেদন করেন তিনি। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)’-এ প্রায় ২ মাস আগেই তার সকল তথ্য ভেরিফাইড হয়। নয়নের প্রতারণায় বিভ্রান্ত হয়ে সিভিল সার্জন অফিসও প্রকৃত আহত হিসেবে এমআইএস-এ তার নাম অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। কিন্তু জুলাই ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন সেলের তৎপরতায় ধরা পড়ে এই প্রতারক।
রাশেদুল ইসলাম নামের আরেক জন ৭ই আগস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকার জাতীয় অর্থপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু) হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু গত ৪ঠা আগস্ট পাবনায় আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি আহত হয়েছেন এমন তথ্য দিয়ে ইতিমধ্যে আহতদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা তুলে নেন। সম্প্রতি আহতদের জন্য বরাদ্দকৃত দ্বিতীয় ধাপের টাকা পাওয়ার জন্য পুনরায় আবেদন করেন। জুলাই ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন সেলের সন্দেহ হলে, তাকে ফাউন্ডেশনের অফিসে ডাকা হয়। তার মেডিকেল রিপোর্টে ‘আরটিএ’, অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন এমন লেখা থাকার ব্যাখ্যা চায় ফাউন্ডেশন।
জবাবে প্রথমে আন্দোলনে গিয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়েছেন এমন কথা বলেন তিনি, পর�� ৭ই আগস্টে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিজয় মিছিলে গিয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন রাশেদুল। জুলাই ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তার দাবি মিথ্যা বলে জানতে পারে। একপর্যায়ে রাশেদুল ও তার বোন স্বীকার করেন যে, কোনো আন্দোলনে তিনি আহত হননি। পরে এক মাসের মধ্যে টাকা ফেরত দেবেন এই মর্মে ২রা মার্চ ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন সেলের কাছে মুচলেকা দিয়ে মামলা হতে আপাতত রেহাই পান তিনি। 
রুনা আক্তার নামের একজন নারী ফাউন্ডেশনে এসেছিলেন আন্দোলনে আহতদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য। পারিবারিক ঝগড়ায় ঠোঁট ফেটে গিয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন তিনি। এর চিকিৎসা সনদ নিয়ে তিনি আন্দোলনে আহত হয়েছেন দাবি করে সহায়তা দাবি করেন। ফাউন্ডেশন যাচাই করে সত্যতা না পেয়ে তাকে কোনো সহায়তা দেয়নি। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)’-এর তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আহতদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা তুলে নেন বেলাল হোসেন নামের এক অটোরিকশাচালক। পুঙ্গ পাসপাতালে ভর্তি এই ব্যক্তির একটা পা কেটেও ফেলতে হয়েছে। কিন্তু ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন সেলের কাছে তথ্য আসে বেলাল আন্দোলনে আহত ব্যক্তি নন। পরে ভেরিফিকেশন টিম তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের পরে জানতে পারে ৩০শে ডিসেম্বর তার অটোরিকশা ছিনতাইয়ের সময় ছিনতাইকারীর গুলি ও ছুরিকাঘাতে আহত হয় বেলাল।

যেহেতু তিনি একটি পা হারিয়েছেন এবং আর্থিকভাবেও তেমন সচ্ছল নন তাই মানবিক কারণে বেলালের নামে আর প্রতারণার মামলা দেয়নি ফাউন্ডেশন। তবে টাকা ফেরত দেয়ার মুচলেকা দিতে হয়েছে তাকে।

জুনায়েদ নামের আরেক প্রতারক দেশের বিভিন্নস্থানে আহতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য যোগাযোগ করতো। আহতদের নানা মিথ্যা তথ্য দিয়ে বলতো, ইতিমধ্যে জুলাই ফাউন্ডেশনের বরাদ্দকৃত টাকা দেয়া শেষ। আপনারা এখনো যেহেতু এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তি করেননি তাই আপনারা আর টাকা পাবেন না। আমার কাছে লোক আছে, আমি আপনার নাম এমআইএস-এ যোগ করে দিবো বিনিময়ে ফাউন্ডেশন থেকে যত টাকা পাবেন তার অর্ধেক টাকা আমাকে দিতে হবে। এতে সফলও হয়েছে সে। পঙ্গু হাসপাতালের এক আহতের বাবার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে নেয় সে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জুনায়েদকে ডেকে আনা হয় ফাউন্ডেশনের অফিসে। জুনাযেদ তার অপরাধ স্বীকার করলে ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তার দেয়া মামলায় জেলহাজতে পাঠানো হয়। 

জুলাই ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন সেলের সমন্বয়ক সাইদুর রহমান শাহীদ মানবজমিনকে বলেন, আমরা জুলাই আন্দোলনের প্রকৃত আহতদের সেবা দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আহতদের নাম তালিকাভুক্তির জন্য আমরা মূলত মেডিকেল সার্টিফিকেটগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করি। এ ছাড়াও আহত ব্যক্তি কখন আন্দোলনে গিয়েছিল, কীভাবে আহত হয়েছিল, তার দেয়া তথ্য নানাভাবে যাচাই করি। এ ছাড়াও স্থানীয় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য নিয়ে তারপর আহতদের নাম তালিকাভুক্ত করি। কিন্তু পঙ্গু হাসপাতালে একসঙ্গে অনেক লোক ভর্তি থাকায় কিছু ভুয়া লোক আহত সেজে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসব ভুয়া আহতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জুলাই ফাউন্ডেশনের লিগ্যাল অফিসার এডভোকেট পায়েল ভুয়া আহতদের ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, আমরা ইতিমধ্যে কিছু ভুয়া আহতদের নাম শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা ভুয়া আহতদের চিহ্নিত করে মামলা দেয়া, মুচলেকা নেয়া এবং টাকা ফেরত চেয়ে শোকজ নোটিশ দেয়াসহ মোট ৩ রকমের ব্যবস্থা নিচ্ছি। 

প্রতারণার মাধ্যমে আহত সেজে টাকা নেয়ার গুরুতর অভিযোগে জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে রাজধানীর রমনা থানায় দেয়া ২টি মামলায় ৩ জন জেলহাজতে আছে। প্রায় ৫০ জনের অধিক প্রতারক আমাদের কাছে মুচলেকা দিয়েছে এবং টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। যদি সময়মতো টাকা না দেয় তবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবো।
এ ছাড়াও যেসব আহত কিংবা নিহতদের পরিবারের সদস্য এককভাবে বরাদ্দকৃত টাকা উঠিয়ে নিয়েছে, অন্য অংশীদারদের বঞ্চিত করেছে তাদের নোটিশের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানানো হয়েছে। যদি কাজ না হয় পরবর্তীতে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিবো।

জুলাই ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তিনটি উইংয়ে কাজ করছে। কেউ যদি ভুল তথ্য দিয়ে ফাউন্ডেশন থেকে টাকা নিয়ে যায় অথবা নেয়ার চেষ্টা করে, আমরা তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিবো।

 

পাঠকের মতামত

কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক এসব প্রতারকদের।

মিলন আজাদ
৭ মার্চ ২০২৫, শুক্রবার, ৪:৪০ পূর্বাহ্ন

Ok. What happen our flood effected feni, commilla, ctg 70 million donation. Where spend ,please Abdullah, nahid inform us.

Kirum
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ১১:৩০ পূর্বাহ্ন

হায়রে বাংলাদেশের মানুষ! এরা কোন কিছুতেই প্রতারণা করতে ছাড়ে না! আমরা জাতি হিসেবে চরম অসভ্য।

বিসমিল্লাহ্ খান
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ১১:১৬ পূর্বাহ্ন

জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশন থেকে বাটপারি করে যারা টাকা নিয়েছে তাদের হাত পা ভেঙ্গে দিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়া হোক।

আব্দুল হালিম
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ৯:৪৯ পূর্বাহ্ন

Banglamen, the sub-species masquerading as Sapiens, are probably genetically corrupt and ill behaved. They breed so fast even bacteria cannot match their growth. The only redress may be eradication.

Muhammad Nurul Islam
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ৯:৪৩ পূর্বাহ্ন

আমরা কি মানুষ হব না?

আবদুল নাইম
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ৯:২৬ পূর্বাহ্ন

জাতিগত ভাবেই আমরা খারাপ।

sadat
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ৯:১৭ পূর্বাহ্ন

কত জঘন‌্য।

Abddul hannan
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ৮:৫৮ পূর্বাহ্ন

Shoot @Sight

জনতার আদালত
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ৭:২৪ পূর্বাহ্ন

চট্টগ্রামের পটিয়ার ইউএনও র কাছে নতুন করে আবেদন এসেছে বলে তিনি জানিয়েছেন। এই আবেদনকারীরা আন্দোলন করেছে এক জায়গায় তালিকা করছে নিজ এলাকায়। অথচ আন্দোলনের পর সরকার গঠনের কয়েকদিনের মধ্যেই এই তালিকা স্থানীয় আন্দোলনকারীরা চূড়ান্ত করে। এখন নতুন করে আবেদনকারীরা প্রত্যেক ভূয়া। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যারা গিয়েছিল তারা টাকার জন্য যায়নি ; দেশকে স্বাধীন করতে গিয়েছিল। যখন শেখ হাসিনা তাদের লোভ দেখালেন ঢালাওভাবে ভাতা দিয়ে তখনই ভূয়ারা তালিকাভুক্ত হতে থাকে। জুলাই বিপ্লবের অবস্থাও এখন তেমন।

A.T.M. Toha
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ৫:১৫ পূর্বাহ্ন

এগুলো হবে আমরা প্রথম থেকেই জানতাম।‌ প্রকৃত নিহত ও আহতদের‌ তালিকা প্রনয়নে সরকারের ব্যর্থতার কারনে বাটপাররা সুযোগ নেবেই। যারা নিহত হয়েছে বলে আমরা শুনি তারা আসলেই আন্দোলনে নিহত হয়েছে কিনা সেটি শত ভাগ নিশ্চিত না হয়ে কোন‌ অর্থ দেয়া উচিত হবে না।

Andalib
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ১:৩১ পূর্বাহ্ন

এ এক আজব চিড়িয়াখানা। বুঝতে পারছি না।

Anwarul Azam
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ১:০৮ পূর্বাহ্ন

যারা এগুলা করেছে তাদের একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা (১৫-৪৫) বেঁধে দিতে হবে। এর���র তাদের গ্রেফতার, বিশাল অঙ্কের জরিমানা করা সহ দরকার হলে তাদের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসতে হবে।

monjur hasan
৪ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ১২:৪০ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status