ইসলামি সংস্কৃতি
ইসলামী সংস্কৃতি হলো মুসলিমদের পালন করা সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং ঐতিহ্যের একটি বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় সংস্করণ। এই অনুশীলনগুলো ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয়ই হতে পারে এবং তা মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। ইসলাম একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, যা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে একত্রিত করেছে। ইসলামের সাধারণ মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসগুলো বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে এবং তাদেরকে একটি সাধারণ পরিচয়ের ভিত্তিতে একত্রিত করতে সহায়তা করেছে। ইসলামী সংস্কৃতি প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের দ্বা��া বিকশিত হয়েছিল। ইসলামের বিস্তারের সাথে সাথে, এটি অন্যান্য সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে প্রভাবিত করেছে। ইসলামের বিস্তার মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলকে একত্রিত করেছে। এই অঞ্চলগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব অন্যান্য সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য ছিল, যা মুসলিম সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছিল। ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই পার্থক্যের কারণে, ইসলামী বিশ্বাসগুলো বিভিন্ন উপায়ে প্রয়োগ করা হয়।
ইসলামী সংস্কৃতি হলো একটি জটিল এবং বৈচিত্র্যময় ধারণা। এটি ইসলামের বিভিন্ন দিক দ্বারা প্রভাবিত এবং এটি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন উপায়ে প্রয়োগ করা হয়।[১]
শিল্প
[সম্পাদনা]ইসলামী শিল্পসমূহ ইসলামী সংস্কৃতির একটি বড় অংশ গঠন করে।[২] ইসলামী শিল্প(সমূহ) শব্দটি একটি অপেক্ষাকৃত নতুন শব্দ। এই শব্দটি প্রথম আধুনিক যুগে ব্যবহৃত হয়েছিল।[২] এর আগে, ইসলামী শিল্পকর্মগুলোকে সাধারণত তাদের নির্দিষ্ট ধরন বা শৈলীর দ্বারা উল্লেখ করা হত। তাই, সাধারণভাবে এটিকে একটি আধুনিক ধারণা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই শব্দের দ্বারা বোঝানো হয় ইসলামী ভূখণ্ডে উৎপাদিত, ইসলামী সংস্কৃতির ছাপ বহনকারী শিল্পকর্মকে। ইসলামী শিল্পের মধ্যে রয়েছে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, অলংকার, কারুশিল্প, এবং অন্যান্য শিল্পকলার বিভিন্ন শাখা। ইসলামী শিল্পসমূহ ইসলামী বিশ্বাস, ঐতিহ্য, এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটায়। এসব শিল্পকর্ম অবশ্যই মুসলমানদের জন্য বা মুসলমানদের দ্বারা তৈরি হওয়ার প্রয়োজন নেই। ইসলামী শিল্প বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং জাতিগত গোষ্ঠীর মানুষের দ্বারা তৈরি হয়েছে।[২] ঐতিহাসিক মুসলিম শিল্পীদের দ্বারা আধুনিক যুগে ইসলামী শিল্পকে ধর্মীয় নয় বরং জাতীয় শিল্পের দিক থেকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। কিছু লোক বিশ্বাস করে যে, ইসলামী শিল্পকে তার ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বোঝা উচিত, অন্যরা বিশ্বাস করে যে, এটিকে তার জাতিগত বা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বোঝা উচিত।[২] এই ধারণাটি সাধারণত ভুল বলে মনে করা হয়। কেননা, ইসলামিক শিল্প সাধারণত ইসলামী বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়।[২] শিল্পগুলো অনেক জাতিগত গোষ্ঠীর অবদানের ফলাফল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ইসলামী শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর অবদান রয়েছে। সেই সময়গুলোতে ইসলামী ভূখণ্ডে বসবাসকারী নাগরিকদের আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। এই কারণে, আজ অনেক ঐতিহাসিক ইসলামী শিল্পীর বাসস্থান ও অঞ্চল দেখে তাদের জাতিগত উৎপত্তি জানা খুব কঠিন।[২]
ইসলাম ধর্মে, আল্লাহকে মানুষের মতো কল্পনা করা নিষিদ্ধ। ইসলামে আল্লাহকে "লা শারিকা লাহু" বলা হয়, যার অর্থ "তার কোনো শরিক নেই"। অর্থাৎ, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি মানুষের মতো নন। তাই তাঁর কোনো রূপ বা ছবি বা মূর্তি বা প্রতিকৃতি তৈরি করাও নিষিদ্ধ (হারাম)। এই কারণে ইসলাম ধর্মে খ্রিস্টধর্মের মতো কোনো ধর্মীয় চিত্রকলার ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি।[২] খ্রিস্টধর্মে, যীশুখ্রিস্টকেমানুষের মতো কল্পনা করা হয়। তাই খ্রিস্টধর্মে, যীশুখ্রিস্টের ছবি এবং মূর্তি তৈরি করা হয়। ইসলাম ধর্মে নবী-রাসূলদের দেবত্ব দেওয়া নিষিদ্ধ।[২] তাই নবী-রাসূলদের ছবিও ধর্মীয় দিক থেকে অপ্রয়ো���নীয়। ইসলামি বিশ্বাসানুসারে, নবী-রাসূলরা হলেন আল্লাহর প্রেরিত মানুষ। তারা মানুষ ছিলেন, দেবতা নয়। তাই তাদের ছবি তৈরি করার কোনো প্রয়োজন নেই। ইসলাম ধর্মে পৌত্তলিকতাকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। পৌত্তলিকতায় মানুষের তৈরি মূর্তি বা ছবিকে পূজা করা হয়। তাই ইসলাম ধর্মে, বিশেষ করে ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকে, শিল্পের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক।[৩] এই সময়ে, ইসলাম ধর্ম খুবই নতুন ছিল। মুসলমানরা পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। তাই তারা শিল্পকে পৌত্তলিকতার সাথে যুক্ত করত। তবে, কুরআনে শিল্পের বিরুদ্ধে কোনো সরাসরি নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই পরবর্তী শতাব্দীতে, বিশেষ করে নতুন করে জয় করা অঞ্চলে, ইসলামিক ধারণা এবং প্রতীকগুলোর সাথে স্থানীয় শিল্প ঐতিহ্যগুলো সংমিশ্রণের ফলে, বিশেষ করে ইরানের অঞ্চলে, মুহাম্মাদসহ অন্যান্য নবী-রাসূলদের ছবি তৈরি করা হয়েছে।[২][৪] তবে, এই ছবিগুলো ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নয়, বরং ঐতিহাসিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই ছবিগুলো মুহাম্মাদ এবং অন্যান্য নবী-রাসূলদের জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে তথ্য প্রদান করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।[২]
পশ্চিমা বিশ্বে, চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য, শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপগুলোর মধ্যে রয়েছে। তবে ইসলামে, এই রূপগুলোকে প্রায়ই শিরক বা ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করার মতো বিবেচনা করা হয়। এই কারণে, ইসলামি শিল্পে এই রূপগুলোর পরিবর্তে অন্যান্য রূপগুলোর উপর জোর দেওয়া হয়েছে।[২] উদাহরণস্বরূপ, ইসলামি শিল্পে কাঠ, ধাতবশিল্প, আলংকারিক শিল্প, পোড়ামাটির শিল্প এবং কাচের শিল্প খুব জনপ্রিয়। এই শিল্পগুলো প্রায়শই জ্যামিতিক এবং প্রতিসম নকশাগুলো ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এই নকশাগুলো আল্লাহর সৃষ্টির জটিলতা এবং সৌন্দর্যকে প্রতিফলিত করে। ইসলামি শিল্পে ক্যালিগ্রাফিও একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ। কুরআন এবং অন্যান্য ইসলামিক পাঠ্যগুলো প্রায়শই ক্যালিগ্রাফিতে লেখা হয়।[২] ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা কুরআনের শব্দগুলোকে সুন্দর এবং বর্ণময় উপায়ে লিখতে এসব ব্যবহার করে।[৩] এই লাইনগুলো ইসলামি শিল্পের বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্যের উপর জোর দেয়। ইসলামি শিল্প শুধুমাত্র চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য থেকে বিরত নয়, এটি একটি অনন্য শৈলী যা বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।[২][৫]
ইসলামী শিল্পে বাস্তবধর্মী চিত্রকর্মকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তাই শিল্পীরা কল্পনাপ্রসূত শৈলীর মিনিয়েচার শিল্পকে বিকশিত করেছিলেন। মিনিয়েচার শিল্প হলো ছোট ছোট ছবির শিল্প, যা প্রায়ই পাতায় আঁকা হয়। ইসলামী মিনিয়েচার শিল্পে প্রায়ই উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষের চিত্রকর্ম দেখা যায়।[৪] হস্তলিপি (চারুলিপি) ইসলামী শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হস্তলিপিতে সুন্দর করে লেখা হয় এ���ং এটি প্রায়ই ধর্মীয় পাঠ্য বা কবিতার জন্য ব্যবহার করা হয়। ইসলামী সমাজে, চিত্রকর্ম নিষিদ্ধ ছিল, তাই হস্তলিপি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।[৬] তৈজস শিল্প হলো হস্তলিপির সাথে সম্পর্কিত একটি আলংকারিক শিল্প। তৈজস শিল্পে প্রায়ই সোনা, রূপা এবং অন্যান্য মূল্যবান পাথরের ব্যবহার করা হয়। তৈজস শিল্প প্রায়ই কুরআনের নুসখাগুলোকে সজ্জিত করতে ব্যবহৃত হয়।[২][৩]
ইসলামিক শিল্পের মধ্যে স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। ইসলামের শুরুর দিকে, মক্কা এবং মদিনা, যেখানে ইসলামের বিকাশ ঘটেছিল, সেখানকার স্থাপত্য খুব উন্নয়নশীল ছিল না। ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন সালতানাতের রূপ নেওয়ার পর স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে।[৭] বিশেষ করে, এই সময়ের মধ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা, প্রাসাদ, সেতু ও ক্যারাভানসরাই নির্মাণের মাধ্যমে স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে। ইসলামের নিজস্ব উপাসনালয় মসজিদের স্থাপত্য, বিশেষ করে ইসলামী স্থাপত্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রথম বিজিত ভূখণ্ডে, বিশেষ করে সিরিয়ার মতো জায়গায়, গির্জাগুলোকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।[৭] তবে, পরে নতুন বিজিত ভূখণ্ডে এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত শহরগুলোকে মুসলমানরা মসজিদ নির্মাণ শুরু করে। বিভিন্ন জলবায়ু এবং জাতিগত সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে মসজিদের স্থাপত্য অঞ্চল থেকে অঞ্চলে ভিন্ন হয়।[৩] এই ধরনের ধর্মীয় স্থানের স্থাপত্যতে চিত্র বর্ণনায় খুব একটা স্থান দেওয়া হয় না। এর পরিবর্তে, সেখানে আলংকারিক, প্রায়ই জ্যামিতিক ও আরবিস্ক ধরনের সজ্জা রয়েছে। ধর্মীয় নয় এমন স্থানের স্থাপত্যতে চিত্র বর্ণনায় স্থান দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিশেষ করে পুরানো হামামে এবং প্রাসাদে এটি দেখা যায়। তবে, ধর্মীয় স্থানের তুলনায় ধর্মীয় নয় এমন স্থানগুলো সময়ের সাথে সাথে ততটা ভালভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।[৮] ইসলামী স্থাপত্যে জ্যামিতিক সজ্জা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সজ্জাটি প্রায়ই মসজিদের দেয়ালে, মেঝেতে এবং ছাদে দেখা যায়। জ্যামিতিক সজ্জা প্রায়ই ইসলামিক ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে যুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, অনেক মুসলমান বিশ্বাস করেন যে মহাবিশ্ব একটি সুন্দর এবং পরিকল্পিত ব্যবস্থা এবং জ্যামিতিক সজ্জা এই ধারণাকে প্রতিফলিত করে। আরবিস্ক হলো একটি জটিল সজ্জামূলক শৈলী যা আরবি লিপির উপর ভিত্তি করে। আরবিস্ক ইসলামী স্থাপত্যেব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।[৩] আরবিস্ক প্রায়ই মসজিদের দেয়ালে, মেঝেতে এবং ছাদে দেখা যায়। এটি প্রায়ই অন্যান্য সজ্জা উপাদানের সাথে একত্রিত হয়। ইসলামী স্থাপত্যে আরেকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এর মিনার। মিনার হলো ইসলামী স্থাপত্যের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মিনারগুলো মসজিদের একটি উঁচু কাঠামো যা মুয়াজ্জিনরা নামাজের জন্য আহ্বান জানানোর জন্য ব্যবহার করেন। মিনারগুলো প্রায়ই মসজিদের মিহরাব বা নামাজের দিকে নির্দেশ করে নির্মিত হয়। গম্বুজ, কলাম এবং গেটওয়ে হল ইসলামী স্থাপত্যে ব্যবহৃত অন্যান্য সাধারণ উপাদান। গম্বুজগুলো প্রায়ই মসজিদের ছাদে দেখা যায়। কলামগুলো প্রায়ই মসজিদের ভিতরে এবং বাইরে পাওয়া যায়। গেটওয়েগুলো প্রায়ই মসজিদ এবং অন্যান্য ইসলামী ভবনগুলোতে দেখা যায়। ইসলামী স্থাপত্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলেছে। ইসলামী স্থাপত্য আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে পাওয়া যায়। ইসলামী স্থাপত্য অন্যান্য সংস্কৃতির স্থাপত্যের উপরও প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামী স্থাপত্যের জ্যামিতিক সজ্জা এবং আরবিস্ক পশ্চিমাস্থাপত্যে প্রভাব ফেলেছে।[২]
ইসলামি শিল্পকলার ক্ষেত্রে বস্ত্র-ভিত্তিক শিল্পগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[২][৩] ইসলামী শিল্পকলায়, বস্ত্র শিল্পের মধ্যে রয়েছে কার্পেট, কাপড়, রুমাল এবং অন্যান্য বস্ত্র পণ্য। এই দ্রব্যগুলো বিভিন্ন ধরনের নকশা এবং কৌশল দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল, যা ইসলামী শিল্পের বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্যের একটি অনন্য উদাহরণ প্রদর্শন করে। বস্ত্র উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবেও একটি বড় আয়ের উৎস ছিল।[২][৩] ইসলামী বিশ্বে, বস্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য ছিল। বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করে বস্ত্র উৎপাদন করা হত, যার মধ্যে ছিল তুলা, রেশম, এবং উল। ইসলামী বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র পণ্য তৈরি করা হত। এই পণ্যগুলো বিভিন্ন শৈলী এবং কৌশল দ্বারা তৈরি করা হত, যার মধ্যে রয়েছে বুনন, সেলাই এবং খোদাই।[৩] মধ্যযুগে গির্জায় পোপদের হাড় রাখার জন্য ব্যবহৃত বেশিরভাগ খোদাই করা কাপড়গুলো ইসলামী অঞ্চল থেকে এসেছিল। এই কাপড়গুলো তাদের সুন্দর নকশা এবং উচ্চমানের জন্য বিখ্যাত ছিল। আজও মধ্যযুগীয় ইসলামী কাপড়গুলো তাদের সৌন্দর্য এবং শিল্পমানের জন্য প্রশংসিত হয়।[২]
বিজ্ঞান
[সম্পাদনা]ইসলাম এবং বিজ্ঞান ইতিহাসে দীর্ঘ সময় ধরে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। ইসলামের প্রথম দিকের যুগে, মুসলমানরা বিজ্ঞানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিবেচনা করত। তারা বিশ্বাস করত যে জ্ঞান অর্জন করা আল্লাহর ইচ্ছা এবং এটি এক ধরনের ইবাদত। এই কারণে, তারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।[৯] ইসলামের স্বর্ণযুগে, ইসলামী ভূখণ্ডে অনেক বিজ্ঞানী গড়ে উঠেছিল এবং বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম খুবই বৃহৎ পরিসরে বিস্তার লাভ করেছিল। এই সময়ের মধ্যে, মুসলমান বিজ্ঞানীরা গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল। তাদের কাজ পশ্চিমা বিশ্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। "ইলম" শব্দটি ইসলামী সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ।[৯][১০] এই শব্দটি বিজ্ঞানের পাশাপাশি জ্ঞানকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। উভয় অর্থই ইসলামের সাথে একীভূত হয়েছে।[১১]
মধ্যযুগে ইসলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময়কালটি সাধারণত ৮ থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত বলে মনে করা হয়। এই সময়কালে, ইসলামী বিশ্বে অনেক বিজ্ঞানী গড়ে উঠেছিল এবং অনেক বৈজ্ঞানিক কাজ করা হয়েছিল। এই কাজগুলো গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ছিল। এই সময়কালে, ইসলামী বিশ্ব বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি এবং শিল্পের মতো অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য রাজ্য এবং অঞ্চলগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এই সাফল্য ইসলামী বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক উত্থানের প্রমাণ। এই সময়কালকে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয় কারণ এই সময়কালে ইসলামী বিশ্ব বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছিল। এই অগ্রগতিগুলো ইসলামী বিশ্বকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী অঞ্চলে পরিণত করেছিল।
ইসলামী বিশ্বে উদ্ভূত বৈজ্ঞানিক ধারণা, ফলাফল এবং বিজ্ঞানীদের সমষ্টিকে কখনও কখনও "ইসলামী বিজ্ঞান" বলা হয়। এটি একটি বিস্তৃত ধারণা যা বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং সময়কালকে অন্তর্ভুক্ত করে। ইসলামী বিজ্ঞানের মধ্যে রয়েছে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর কাজ। "ইসলামী বিজ্ঞান" এর মাধ্যমে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে তা বিতর্কের বিষয়। কিছু লোক বিশ্বাস করে যে এটি শুধুমাত্র মুসলিম বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত গবেষণাকে বোঝায়, অন্যরা বিশ্বাস করে যে এটি আরও ব্যাপকভাবে ইসলামী বিশ্বে পরিচালিত সমস্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে বোঝায়।[১০] ইসলামী বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং বিজ্ঞানীদেরকে আরববৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং বিজ্ঞানীদের সাথে একই নয় বলে বিবেচনা করা উচিত নয়। এর কারণ হলো যে এই সময়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর থেকে এসেছিলেন। তাদের সাধারণ বিষয় ছিল জাতিসত্তার চেয়ে ইসলামী রাজ্যে বসবাসকারী মুসলমান হওয়া। উদাহরণস্বরূপ, আবু রায়হান আল-বেরুনি একজন পারস্য বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী ছিলেন যিনি মধ্যযুগীয় ইসলামী বিশ্বে কাজ করেছিলেন। তিনি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল এবং অন্যান্য বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তিনিকে প্রায়ই "ইসলামী বিজ্ঞানের জনক" বলা হয়। অন্যদিকে, ইবনে সিনা একজন পারস্য বংশোদ্ভূত দার্শনিক, চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী ছিলেন যিনি মধ্যযুগীয় ইসলামী বিশ্বে কাজ করেছিলেন। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তাকে প্রায়ই "ইসলামী চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক" বলা হয়।[১২]
আব্বাসীয় যুগে, হারুনুর রশিদ দ্বারা বাগদাদে "বাইতুল হিকমাহ" (জ্ঞানের ঘর) নামে একটি বিজ্ঞান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে "ইসলামের স্বর্ণযুগ" শুরু হয়েছিল। "বাইতুল হিকমাহ" ছিল একটি বইয়ের ভাণ্ডার, একটি অনুবাদ কেন্দ্র এবং একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এই প্রতিষ্ঠানটি ইসলামী বিশ্বে বিজ্ঞান ও শিক্ষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কিছু সূত্র অনুসারে এই সময়কাল ১৪ শতক পর্যন্ত, কিছু সূত্র অনুসারে ১৫ শতক, এমনকি ১৬ শতক পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। তবে, বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে, এই সময়কাল ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের দ্বারা বাগদাদের পতন এবং আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের সাথে শেষ হয়েছিল। এই সময়ে আল-কিন্দি, আল ফারাবী, আল-খারেজমি, জাবির ইবনে হাইয়ান, ইবনে সিনা, ইবনে হাইসাম, আল বিরুনী, ইবনে রুশদ, আল-জাজারী, আল গাজ্জালী, ইবনে খলদুন, ইবনে বতুতা, উলুঘ বেগ এবং আরও অনেক বিখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। এই যুগে, ভারত থেকে আন্দালুস পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হচ্ছিল। ঔষধ, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, ইসলামী আইন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা করা হচ্ছিল। এই সময়ে, প্রাচীন গ্রীস সহ অতীত সভ্যতার উৎপাদিত জ্ঞান ও চিন্তাভাবনা, অনুবাদের মাধ্যমে ইসলামী বিশ্বে এবং আন্দালুসের মাধ্যমে ইউরোপে স্থানান্তরিত হয়েছিল। এই অনুবাদগুলো ইউরোপীয় রেনেসাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি প্রদান করেছিল। চীনাদের সাথে যুদ্ধ এবং অন্যান্য সম্পর্ক চলাকালীন আরবরা কাগজ উৎপাদন কৌশল শিখেছিল এবং পাণ্ডুলিপির পরিবর্তে কাগজের ব্যবহারের মাধ্যমে লিখিত রচনাগুলো আরও সহজে ছড়িয়ে পড়েছে। কাগজের আবিষ্কার ইসলামী বিশ্বে শিক্ষা ও জ্ঞানবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। গণিত ক্ষেত্রে, ভারত থেকে প্রাপ্ত শূন্য এবং দশমিক পদ্ধতির আবিষ্কারের ফলে গণিতের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং পাটিগণিত সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে এমন একটি অবস্থায় এসেছিল এবং তা তারা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে পারত। গণিত ও পাটিগণিতের পাশাপাশি ত্রিকোণমিতিও এই সময়ে বিকশিত হয়েছে। এই সময়ে মানমন্দির নির্মিত হয়েছিল; আলোকবিজ্ঞান এবং রসায়ন বিপুলভাবে বিকশিত হয়।
ইসলামী বিশ্বে বিজ্ঞানের উন্নয়নে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের রচনাগুলোর অনুবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই রচনাগুলোর মধ্যে ছিল গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা, দর্শন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানের উপর কাজ। ইসলামী বিজ্ঞানীরা এই রচনাগুলো থেকে শিখেছিলেন এবং তাদের উপর ভিত্তি করে নতুন আবিষ্কার এবং উদ্ভাবন করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের রচনাগুলোর অনুবাদ অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ঘটেছিল।[১৩][১৪][১৫][১৬] এই সময়ে, ইসলামী বিশ্বে শিক্ষা এবং বিজ্ঞানের একটি নতুন যুগ শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে, পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা ইসলামী বিশ্বে হারিয়ে যাওয়া বা ভুলে যাওয়া অনেক প্রাচীন গ্রিক রচনা আবিষ্কার করেছিলেন। এই রচনাগুলো পশ্চিমা বিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইসলামী বিশ্বে একটি নতুন দর্শন এবং বিজ্ঞান ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল যা প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের রচনাগুলো থেকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল। এই ঐতিহ্যটি অন্যান্য কিছু বাহ্যিক কারণের দ্বারাও পুষ্ট ছিল, যেমন ইসলাম ধর্ম এবং ইসলামী সংস্কৃতি। আল ফারাবী,[১৭] ইবনে সিনা[১৮] এবং ইবনে[১৮] রুশদছিলেন ইসলামী বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক। তারা প্রাচীন গ্রিক দর্শন এবং বিজ্ঞানের উপর তাদের কাজের জন্য পরিচিত। তাদের কাজ পশ্চিমা বিশ্বে দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশকে প্রভাবিত করেছিল।[১৪]
ইসলামী দর্শনের মধ্যে অনেক ধারার উদ্ভব ঘটে। এই ধারাগুলোকে সাধারণত আস্তিক ও নাস্তিক এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। আস্তিক ধারার চিন্তা ইসলামের মূল বিষয়বস্তুকে স্বীকার করে, যেমন আল্লাহর অস্তিত্ব, নবীগণের প্রামাণ্যতা, পরকাল ইত্যাদি। অন্যদিকে নাস্তিকধারার চিন্তা ইসলামের মূল বিষয়বস্তুকে অস্বীকার করে। এটিকে বস্তুবাদও বলা হয়। বস্তুবাদী দর্শন হলো এমন একটি দর্শন যা মনে করে যে সবকিছুই বস্তুগত। বস্তুবাদীরা বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর বা আত্মা এই ধরনের বস্তুগত জিনিস নয়, তাই তাদের অস্তিত্ব নেই।[১৯]ইসলামের দর্শনের মধ্যে দুইটি প্রধান ধারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি ধারা হলো ইসলামী মূলনীতিগুলোকে প্রাধান্য দেয় এবং অন্য ধারাটি ইসলাম ও গ্রীক দর্শনের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করে। প্রথম ধারার দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন যে পরকাল শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক হবে, মহাবিশ্ব চিরন্তন নয় এবং ঈশ্বর শূন্য থেকে সব সৃষ্টি করেননি। তারা মনে করেন যে ঈশ্বর সর্বদা ছিলেন এবং সবকিছু তাঁর থেকে উদ্ভূত হয়েছে। দ্বিতীয় ধারার দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন যে পরকাল শারীরিকও হতে পারে, মহাবিশ্ব চিরন্তন হতে পারে এবং ঈশ্বর শূন্য থেকে সৃষ্টি করতে পারেন। তারা মনে করেন যে গ্রীক দর্শনের কিছু ধারণা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এই ধারণাগুলোকে ইসলামী দর্শনে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ইসলামি তত্ত্বশাস্ত্র হলো যুক্তিবাদী এবং বহিরাগত প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত আরেকটি ধারা।[২০] এটি ইসলামি বিশ্বাস এবং ধর্মীয় রীতিনীতির একটি যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা। এটি গ্রিক দার্শনিকদের রচনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত। সময়ের সাথে সাথে ইসলামি দার্শনিক এবং তত্ত্ববিদরা বিভক্ত হয়ে গেছে এবং প্রায়শই বিতর্কের ক্ষেত্রে বিরোধী দলে অবস্থান নিয়েছে। এই বিভক্তির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দর্শনের উপর তাদের জোর, বিভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতিতে তাদের বিশ্বাস এবং বিভিন্ন দর্শনের উপর তাদের ব্যাখ্যা। ইসলামি দার্শনিকরা গ্রিক দার্শনিকদের রচনা এবং দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে ইসলামী ভিত্তিতে বিবেচনা করে এবং বিভিন্ন নীতিগুলো ব্যাখ্যা করেছিলেন। তারা যুক্তি এবং প্রমাণের উপর জোর দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, তত্ত্ববিদরা আরও ঐতিহ্যবাহী পথ গ্রহণ করেছিলেন এবং গ্রিক দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে দ্বিতীয় সারিতে রেখেছিলেন। তারা ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং কর্তৃত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন। বিশেষ করে আশ'আরী তত্ত্ববিদরা এই বিষয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং বৈজ্ঞানিক কার্যকারণকে অস্বীকার করেছিলেন। আশ'আরীরা বিশ্বাস করতেন যে, আল্লাহ সবকিছুর কারণ এবং তিনিই সরাসরি বিশ্বের ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ শুধুমাত্র একটি অনুমান এবং এটি বাস্তবতার একটি সঠিক প্রতিফলন নয়।[২০]
ইসলাম ধর্ম বিজ্ঞান চর্চার পক্ষে এবং তা উৎসাহিত করে। কুরআনে বিজ্ঞান সম্পর্কিত অনেক আয়াত রয়েছে যেগুলো মানুষকেচিন্তাভাবনা এবং জিজ্ঞাসা করতে উৎসাহিত করে। এছাড়াও, ইসলামে জ্ঞানকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে, জ্ঞান অর্জনের জন্য পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যেতে হবে। এই কারণে, মধ্যযুগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে ইসলামী বিশ্বে উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানীরাজন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন: হাসান ইবনুল হায়সাম, আবু রায়হান আল-বেরুনি, ইবনুন নাফিস, ইবনে বাজা, ইবনে তুফায়েল, মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল-খারেজমি, জাবির ইবনে হায়য়ান, আল-বাত্তানী, ওমর খৈয়াম, ইসমাইল আল-জাযারি, ইবনে খালদুন, নাসিরুদ্দীন তুসী, তাক্বী আদ দীন।[২১][২২] এই বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। হাসান ইবনুল হায়সাম আলোর প্রতিফলন এবং প্রতিসরণ সম্পর্কে তার কাজের জন্য বিখ্যাত। আবু রায়হান আল-বেরুনি জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল এবং গণিতে তার কাজের জন্য বিখ্যাত। ইবনুন নাফিস রক্ত সঞ্চালন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত। ইবনে বাজা জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতে তার কাজের জন্য বিখ্যাত। ইবনে তুফায়েল দার্শনিক গল্পের জন্য বিখ্যাত। মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল-খারেজমি গণিতে তার কাজের জন্য বিখ্যাত। জাবির ইবনে হায়য়ান রসায়নে তার কাজের জন্য বিখ্যাত। আল বাত্তানী জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতে তার কাজের জন্য বিখ্যাত। ওমর খৈয়াম জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং কবিতার জন্য বিখ্যাত। ইসমাইল আল-জাযারি যন্ত্র-প্রকৌশলে তার কাজের জন্য বিখ্যাত। ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞানে তার কাজের জন্য বিখ্যাত। নাসিরুদ্দীন তুসী জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং প্রকৌশলে তার কাজের জন্য বিখ্যাত। তাক্বী আদ দীন জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতে তার কাজের জন্য বিখ্যাত। এই বিজ্ঞানীদের অনেকের আবিষ্কার এবং কাজ পশ্চিমা বিজ্ঞানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁদের আবিষ্কার এবং কাজ পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেছে। এই মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার এবং কাজ অত্যন্ত ব্যাপক ছিল। তারা দর্শন, গণিত, চিকিৎসা, আইন, জ্যোতির্বিদ্যা এবং সমাজবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।[২৩][২৪]
সাহিত্য
[সম্পাদনা]ইসলামে ভাষা ও সাহিত্য প্রধানত আরবী, ফার্সি, ভারতীয়, কুর্দি, তুর্কি ও বাংলা সাহিত্যের দ্বারা গঠিত এবং বিকশিত হয়েছে।
ইসলামী সাহিত্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম হলো আরব্য রজনীর গল্প। এই গল্পগুলো মধ্যযুগে মধ্যপ্রাচ্যে ফ্রেম গল্পের কৌশল ব্যবহার করে রচিত হয়েছিল। গল্পের মূল চরিত্র হল শেরজাদ, যিনি তার স্বামী, রাজা শাহরিয়ারকে তার গল্পের সাথে বিনোদন দিয়ে তার জীবন বাঁচায়। আরব্য রজনীর গল্পগুলো ১০ শতকের দিকে রচিত হওয়া শুরু হয় এবং ১৪ শতক পর্যন্ত তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এই সময়ের মধ্যে, গল্পগুলোতে অনেকগুলো নতুন গল্প যোগ করা হয়েছিল এবং তারা বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। আরব্য রজনীর গল্পগুলো ১৮ শতকে পশ্চিমা সাহিত্যে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, যখন ফরাসি অনুবাদক অ্যান্টোইন গ্যাল্যান্ড এই গল্পগুলোকে অনুবাদ করেছিলেন। গ্যাল্যান্ডের অনুবাদটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল এবং এটি পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আরব্য রজনীর গল্পগুলোর প্রচার করতে সাহায্য করেছিল। আরব্য রজনীর গল্পগুলোর অনেকগুলো অনুকরণ লেখা হয়েছে, বিশেষ করে ফ্রান্সে। এই অনুকরণ গল্পগুলোর বিভিন্ন দিককে অন্বেষণ করেছে এবং তারা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আরব্য রজনীর গল্পগুলোর প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।[২৫] আলাদীনের জাদুর প্রদীপ, আলিবাবা ও চল্লিশ চোর এবং নাবিক সিন্দাবাদ আরব্য রজনীর সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই গল্পগুলো বিশ্বজুড়ে পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়।
আরবি সাহিত্য হলো আরবি ভাষায় রচিত সাহিত্য, যার মধ্যে গদ্য এবং কবিতা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আরবি সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি। আরবি ভাষায় সাহিত্যের জন্য ব্যবহৃত শব্দটি হলো "আদব", যা আরবি ভাষার "আদব" থেকে এসেছে। "আদব" শব্দের অর্থ নৈতিকতা, সংস্কৃতি এবং সমৃদ্ধি। তাই, আরবি সাহিত্যকে "আদব" বলা হয় কারণ এটি আরব সংস্কৃতির এবং আরবি ভাষার সমৃদ্ধির একটি প্রতিফলন। আরবি সাহিত্য পঞ্চম শতাব্দীতে উদ্ভূত হয়েছিল। এর আগে, আরবি ভাষালিখিত ভাষা ছিল না। পঞ্চম শতাব্দীতে, আরবরা আরবি ভাষাকে একটি লিখিত ভাষায় রূপান্তরিত করে এবং আরবি সাহিত্যের বিকাশ শুরু করে। কুরআন হলো আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এটি আরবি ভাষা সাহিত্যের একটি অসামান্য উদাহরণ এবং এটি আরব সংস্কৃতি ও ধর্মের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। কুরআন আরবি সাহিত্যের বিকাশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা ছিল। আরবি সাহিত্য ইসলামের স্বর্ণযুগে বিকাশ লাভ করেছিল। এই সময়ে, আরব কবি এবং লেখকরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রচনা করেছিলেন, যা আজও আরবি সাহিত্যের অতুলনীয় সম্পদ। আরবি সাহিত্য আজও জীবিত রয়েছে এবং আরব বিশ্বের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য অংশের কবি ও গদ্য লেখকদের দ্বারা অনুশীলন করা হয়।
ফার্সি সাহিত্য হলো ফার্সি ভাষায় রচিত মৌখিক রচনা এবং লিখিত পাঠ্যগুলোর সমষ্টি। এটি একটি বিস্তৃত ধারণা যা কবিতা, গদ্য, নাটক, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মতো বিভিন্ন ধরণের সাহিত্যিক কাজকে অন্তর্ভুক্ত করে। ফার্সি সাহিত্যের ইতিহাস ২৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো।[২৬][২৭][২৮] ফারসি ভাষার উৎপত্তি প্রাচীন ইরানে, যা বর্তমানের ইরান, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ককেসাসএবং তুরস্ক নিয়ে গঠিত। এছাড়াও, ফারসি ভাষা মধ্য এশিয়ার কিছু অঞ্চলে এবং দক্ষিণ এশিয়ায়, যেখানে এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রধান বা সরকারী ভাষা ছিল, সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে। জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি ছিলেন একজন বিখ্যাত ফারসি কবি যিনি ১৩ শতকে বাল্খ (বর্তমান আফগানিস্তান) এ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার রচনাগুলো ফারসি ভাষায় লিখেছিলেন, যা তিনি মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। গজনভি সাম্রাজ্যের উত্থান, যা মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জয় করেছিল এবং দরবারের ভাষা হিসাবে ফারসি ভাষাকে গ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে, বৃহৎ সেলজুক সাম্রাজ্যের উত্থান, যা যদিও তুর্কি উপজাতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবুও তারা তাদের মধ্যে তুর্কি-ফারসি ঐতিহ্যকে ধারণ করেছিল এবং সময়ের সাথে সাথে ইরানি হয়ে উঠেছিল। কিছু লোক মনে করেন যে, অন্যান্য ভাষা থেকে ফার্সিতে অনুবাদ করা কাজগুলোও ফারসি সাহিত্যের অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়। এই কারণে, সমস্ত ফারসি সাহিত্য ফারসি ভাষায় লেখা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, খোরাসনের শাসক নাসির খসরু (৯৭৬-১০১০) গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর"রিপাবলিক" গ্রন্থটি ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। এই অনুবাদটি ফারসি সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়, যদিও এটি ফারসি ভাষায় লেখা হয়নি। সমস্ত ফারসি ভাষায় লেখা কাজগুলো ফারসি বা ইরানি লেখকদের দ্বারা লেখা হয়নি। কারণ, তুর্কি, ককেশীয় এবং ভারতীয় কবি এবং লেখকরাও ফারসি সংস্কৃতির পরিবেশে ফারসি ভাষা ব্যবহার করেছেন।[২৯] উদাহরণস্বরূপ, তুর্কিকবি ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১) তার বিখ্যাত রুবাইয়াৎ কাব্য ফারসি ভাষায় লিখেছিলেন। তিনি একজন তুর্কি ছিলেন না, তবে তিনি ফারসি সংস্কৃতির মধ্যে বড় হয়েছেন এবং ফারসি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। ফেরদৌসি, শেখ সাদি, হাফেজ শিরাজি, ফরিদ উদ্দিন আত্তার, নিজামী গঞ্জেভী, জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি এবং ওমর খৈয়াম সহ ফারসি কবিরা পশ্চিমা সাহিত্যেও পরিচিত এবং অনেক দেশের সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছেন। এই কবিরা তাদের কাব্যিক প্রতিভা এবং দর্শনের জন্য বিখ্যাত। তাদের কাজগুলো বিশ্বজুড়ে পাঠকদের অনুপ্রাণিত করেছে।
কুর্দি সাহিত্য হলো কুর্দি ভাষায় রচিত মৌখিক এবং লিখিত সাহিত্যকর্মের সমষ্টি। কুর্দি ভাষা একটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা যা মধ্যপ্রাচ্যএবং এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে বসবাসকারী কুর্দি জনগোষ্ঠী দ্বারা কথিত হয়। কুর্দি সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, যা কয়েক শতাব্দী ধরে রয়েছে। ইসলামের আগ পর্যন্ত, কুর্দিরা একটি মৌখিক সংস্কৃতি ছিল। তাদের কোনো লিখিত সাহিত্য ছিল না। তাই, ইসলামপূর্ব কুর্দি সাহিত্যের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বা তথ্য নেই। কুর্দি কাহিনীর একটি বড় অংশ মৌখিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এই মৌখিক সাহিত্য আজও চলমান। কুর্দি কাহিনীর একটি বড় অংশ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুখে মুখে বলা হয়েছে। এই কাহিনীগুলো কুর্দি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তারা কুর্দিদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। ২০ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত লিখিত সাহিত্য ছিল কবিতা আকারে। গদ্যের বিকাশ মূলত রাজনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের কারণে হয়েছে। এই উন্নয়নগুলো কুর্দিদের মধ্যে শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে, যা গদ্যের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। কুর্দি সাহিত্য ২০ শতকে দশক ধরে সীমাবদ্ধতা এবং নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে। কুর্দিরা একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী এবং তাদের উপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার দ্বারা নিপীড়ন চালানো হয়েছে। এই নিপীড়নগুলো কুর্দি সাহিত্যের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। পরিচিত প্রথম কুর্দি কবিরা হলেন আবদুসসামেদ বাবেক, আলী হারিরী, মেলায়ে বাতে, মোল্লা আহমেদ-ই জিজারী, ফকি তেইরান এবং আহমেদ-ই হানি। এই কবিরা ১০ম থেকে ১৭শ শতাব্দীর মধ্যে বাস করতেন এবং কুর্দি ভাষার বিভিন্ন উপভাষায় লিখেছেন।[৩০] বিশেষ করে আহমেদ-ই হানি রচিত মেম ও জিন হলো সবচেয়ে পরিচিত রোমান্টিক কুর্দি রচনা। মেম ও জিন হলো একটি মহাকাব্য যা দুটি প্রেমিকের গল্প তুলে ধরে। এই মহাকাব্যটিকুর্দি সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে এবং এটি কুর্দি ভাষার একটি জনপ্রিয় রচনা। সবচেয়ে সুপরিচিত এবং ব্যাপকভাবে পরিচিত ঐতিহ্য হলো মেমে আলানের গান এবং মহাকাব্যিক কবিতা এবং সিয়বানদ এবং খেচে ঐতিহ্য। মেমে আলা একজন বিখ্যাত কুর্দি যোদ্ধা এবং তার গান ও মহাকাব্যিক কবিতা কুর্দি সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সিয়বানদ এবং খেচে হলো একটি দুঃখজনক প্রেমের গল্প যা কুর্দি সংস্কৃতিতে একটি জনপ্রিয় থিম।
পারস্য-ইসলামী সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে শুরু করে যখন ভারত গজনভি সাম্রাজ্য দ্বারা দখল করা হয়েছিল। গজনভিরা ছিল একটি পারস্য-তুর্কি সাম্রাজ্য যা দশম শতাব্দীতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তাদের শাসনকালে, তারা পারস্য ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মকে ভারতীয় সমাজে প্রবর্তন করেছিল। ফারসি ভাষা বেশিরভাগ ভারতীয় সাম্রাজ্যের সরকারী ভাষা হয়ে ওঠে। গজনভি সাম্রাজ্য, দিল্লি সালতানাত, বাংলা সালতানাত, দক্ষিণাত্য সালতানাত এবং মুঘল সাম্রাজ্য সহ অনেক ভারতীয় সাম্রাজ্য ফারসি ভাষাকে তাদের সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ফারসি ভাষার এই ব্যবহার ভারতীয় সংস্কৃতিতে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। ফারসি শিল্প কর্মগুলো, যেমন সাহিত্য এবং গজলগুলো, উর্দু এবং অন্যান্য ভারতীয় সাহিত্যকেউল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছিল।
বাংলা মুসলমি সাহিত্য হলো বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য যা বাঙালি মুসলিমদের দ্বারা রচিত বা তাদের জীবন ও সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করে। এই সাহিত্যের ইতিহাস মধ্যযুগে শুরু হয় এবং আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে ইসলাম ধর্মের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।[৩১] তুর্কি মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বঙ্গদেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েমের ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নবজন্ম ঘটে। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়কালে বাংলা মুসলিম সাহিত্যের সর্বাধিক বিস্তার ঘটে। ওই সময়কার মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রাচীনতম হচ্ছেন- শাহ মুহম্মদ সগীর। তার কাব্য ইউসুফ-জুলেখা' সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৮৯-১৪১০) রচিত বলে মনে করা হয়। এটি নবী ইউসুফ এর সংক্ষিপ্ত কাহিনী। কবি জৈনুদ্দীন রসুলবিজয় কাব্য রচনা করেছিলেন। তিনি গৌড় সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-৮১) সভাকবি ছিলেন। মুজাম্মিল ১৫শ' শতকের মধ্যবর্তী সময়ের কবি ছিলেন। তিনি প্রধানত তিনটি উল্লেখযোগ্য কাব্য রচনা করেন, নীতিশাস্ত্রবার্তা, সায়াৎনামা' ও 'খঞ্জনচরিত'। এর গল্পাংশ ফারসি থেকে নেওয়া। দোনাগাজীর বিখ্যাত কাব্য সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল'। তিনি সম্ভবত ১৬শ' শতকের মধ্যভাগের বাঙালি মুসলিম কবি। শেখ ফয়জুল্লাহ মধ্যযুগের একজন বিশিষ্ট বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক। তিনি পাঁচটি গ্রন্থ রচনা করেন, গোরক্ষবিজয়', 'গাজীবিজয়', 'সত্যপীর (১৫৭৫)', জয়নবের চৌতিশা' এবং রাগনামা'। দৌলত উজীর বাহরাম খাঁর রচনা করেন লায়লী-মজনু'; এটি ফারসি কবি জামীর 'লাইলী-মজনু' কাব্যের ভাবানুবাদ। এ ছাড়া মধ্যযুগে অন্যান্য মুসলমান কবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- সৈয়দ সুলতান (আনু. ১৫৫০-১৬৪৮, কাব্য: নবীবংশ, শব-ই-মিরাজ, রসুলবিজয়, ওফাৎ-ই-রসুল, জয়কুম রাজার লড়াই, ইবলিসনামা, জ্ঞানচৌতিশা, জ্ঞানপ্রদীপ, মারফতি গান, পদাবলি), নসরুল্লাহ্ খাঁ(আনু. ১৫৬০-১৬২৫, কাব্য: জঙ্গনামা, মুসার সওয়াল, শরীয়ৎনাম), শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ হামজা, শাহ গরীবুল্লাহ, শেখ চান্দ, সৈয়দ আলাওল, নওয়াজিস খান, সৈয়দ মোহাম্মদ আকবর, আলি রজা, দৌলত কাজী, মুহম্মদ কবির, দোনাগাজী চৌধুরী, দৌলত উজির বাহরাম খান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।[৩১] বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্যচর্চা অনেক আগে থেকে শুরু হলেও মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীরমাঝামাঝি এবং বিংশ শতকের শুরুতে মুসলমানদের সাহিত্য সাধনার নতুন ধারার সূচনা হয়। আধুনিক যুগে শেখ আবদুর রহিমহজরত মহাম্মদ (সা.)'র জীবনচরিত ও ধর্মনীতি (১৮৮৭) রচনা করেন।[৩১] গোলাম মোস্তফা রচিত বিশ্বনবী (১৯৪২) মুহাম্মাদ এর শ্রেষ্ঠ জীবনী গ্রন্থগুলোর অন্যতম। এ সময়ে মুসলিম সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা অনবদ্য অবদান রেখেছেন, তাদের আরও কয়েকজন হলেন- দীন মোহাম্মদ, এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪০), কাজী আকরম হোসেন (১৮৯৬-১৯৬৩), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪ খ্রি.), শেখ ফজলল করিম (১৮৮২-১৯৩৬ খ্রি.), আব্বাসউদ্দীন (১৯০১-১৯৫৯ খ্রি.), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১ খ্রি.), কবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১ খ্রি.), মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭ খ্রি.), মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০ খ্রি.) ও মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৯ খ্রি.), মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯), এস ওয়াজেদ আলী(১৮৯০-১৯৫১), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), কবি বন্দে আলী মিয়া (১৯০৭-১৯৭৫) ও বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) প্রমুখ।[৩১] বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা তাফসির রচনা করেন শামসুল হক ফরিদপুরী(১৮৯৬-১৯৬৯)। বাংলা মুসলিম সাহিত্যের ইসলামি কবিতা ও গানের (গজল) ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামি ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি কিনা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচিত। নজরুল প্রচুর ইসলামী ভাবধারার কবিতা ও গান রচনা করেছেন। তার হাত ধরেই বাংলায় ইসলামী গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর রচিত ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ বাঙালি মুসলিম সমাজে এক প্রকার আলোড়ন এবং নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। এই গানটি ছাড়া বর্তমানে বাঙালি মুসলিমের ঈদ এক প্রকার অসম্পূর্ণই থেকে যায়।[৩২] নজরুলের ইতিহাস সৃষ্টিকারী আত্মচারিত্রিক কালজয়ী কবিতা‘বিদ্রোহী’'তেও রয়েছে ইসলামী ভাবধারার প্রভাব। নবী মুহাম্মাদ এর এর শানে তিনি অসংখ্য নাত রচনা করেছেন। যার মধ্যে ‘ত্রিভূবনের প্রিয় মুহাম্মাদ’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’, ‘আমি যদি আরব হতাম’, ‘তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি একের পর এক কালজয়ী ইসলামি কবিতা ও গজল রচনার মাধ্যমে বাংলা মুসলিম সাহিত্যকে এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে যান।[৩৩] বাঙালি মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের রচিত সাহিত্যে সমাজ সংস্কারের চিন্তা-চেতনা, জাতীয় ঐতিহ্যের ধ্যান-ধারণা, আত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান প্রতিফলিত হয়।
১১ শতকে, তুর্কিরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর, তুর্কি ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু হয়ে���িল। এই সাহিত্যটি ইসলামি বিষয়বস্তুতে ভিত্তি করে ছিল এবং ফার্সি, আরবি এবং তুর্কি ভাষায় রচিত হয়েছিল। ১১ শতকে, সেলজুকদের আগমনের সাথে সাথে ফারসি ভাষার প্রয়োগ এবং ব্যবহার আনাতোলিয়ার অঞ্চলে শক্তিশালীভাবে পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। সেলজুকরা ফারসি ভাষা, শিল্প এবং সাহিত্যের প্রবক্তা ছিলেন এবং তারা ফারসি ভাষাকে তাদের সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। এই ঐতিহ্যটি উসমানীয় সাম্রাজ্য দ্বারাও অনুসরণ করা হয়েছিল। উসমানীয়দেরকে সেলজুকদের উত্তরসূরি হিসাবে দেখা হতো এবং তারা সেলজুকদের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেছিল। উসমানীয় সাম্রাজ্য ফারসি ভাষাকে তাদের সাহিত্য ভাষা হিসাবে ব্যবহার করেছিল এবং ফারসি ভাষায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য রচনা করেছিল। ফারসি ভাষা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাহিত্য ভাষা ছিল। উসমানীয় সাম্রাজ্যের লেখকরা ফারসি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছিলেন এবং ফারসি ভাষা আনাতোলিয়ার ইসলামি সাহিত্যের বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।[৩৪] তুর্কি ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম রচনাগুলো ১৩ শতকের শেষ এবং ১৪ শতকের শুরুর দিকে তুরস্কের মাটিতে রচিত হয়েছিল। এই রচনাগুলো ছিল মৌখিক এবং লিখিত উভয়ই।[৩৫] ১৯ শতক পর্যন্ত তুর্কি সাহিত্য ফারসি-ইসলামি ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিকাশ লাভ করেছিল। এই সময়কালে, তুর্কি সাহিত্যদুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত ছিল: লোক সাহিত্য এবং দেওয়ানি সাহিত্য। লোক সাহিত্য ছিল মৌখিক সাহিত্য যা জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এটি গল্প, কবিতা, গান এবং লোককাহিনী সহ বিভিন্ন রূপের সমষ্টি ছিল।[৩৬] দেওয়ানি সাহিত্য ছিল উচ্চতর সাহিত্য যা উসমানীয় দরবারের চারপাশে বিকাশ লাভ করেছিল। এটি ফারসি সাহিত্যের প্রভাবের অধীনে ছিল এবং কবিতা, গদ্য ও নাটক সহ বিভিন্ন রূপে বিভক্ত ছিল। উসমানীয় দরবারের চারপাশে, দেওয়ানী সাহিত্য প্রাধান্য পেয়েছিল। এর কারণ ছিল ফারসি সাহিত্যের প্রভাব, যা উসমানীয় দরবারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জনসাধারণের মধ্যে মৌখিক ঐতিহ্য দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত ছিল। এর কারণ ছিল লোক সাহিত্যের জনপ্রিয়তা, যা জনসাধারণের মধ্যে শক্তিশালী সংযোগ ছিল। ১৯ শতকে, তানযিমাত যুগের সাথে সাথে তুর্কি সাহিত্যে পূর্বের প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করে। এর কারণ ছিল পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, যা তানযিমাত যুগের লেখকদের উপর একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল।[৩৬] এই সময়ে, তুর্কি সাহিত্যিকরা বিশেষ করে ফরাসি সাহিত্য থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এর কারণ ছিল ফরাসি সাহিত্যের সাফল্য এবং এর আধুনিকতার ধারণা।
থিয়েটার, সিনেমা ও সঙ্গীত
[সম্পাদনা]ইসলাম থিয়েটারকে অনুমতি দেয়। যদিও ইসলামে থিয়েটারকে অনুমতি দেওয়া হয়, তবে এটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। থিয়েটারপ্রযোজনার ক্ষেত্রে, আল্লাহ, মুহাম্মাদ, অন্যান্য নবী-রাসূল, সাহাবী এবং ফেরেশতাদের চিত্রায়ন করা নিষিদ্ধ। এছাড়াও, থিয়েটারপ্রযোজনাগুলো ইসলামী মূল্যবোধ এবং শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।[৩৭]
মধ্যযুগীয় ইসলামী বিশ্বে পুতুল নাটক এবং তাজিয়া নামে পরিচিত জীবন্ত নাটক ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় নাট্য রূপ। পুতুল নাটকগুলো সাধারণত ইসলামপূর্ব কিংবদন্তি বা ইসলামী মহাকাব্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। তাজিয়াগুলো ছিল ধর্মীয় নাটক যা আলী এবং তার পরিবারের শহীদ হওয়ার ইতিহাসকে স্মরণ করে। শিয়া ইসলামী নাটকগুলো বিশেষভাবে হাসান এবং হোসাইনের শহীদ হওয়ার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। হাসান এবং হোসাইন ছিলেন মুহাম্মাদ-এর নাতি এবং আলী-এর পুত্র। তারা তাদের চাচা মুয়াবিয়া-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত এবং নিহত হন। শিয়া মুসলমানরা তাদের শহীদদের জন্য গভীর শ্রদ্ধাশীল এবং তাজিয়াগুলো তাদের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ইন্দোনেশিয়ার ওয়ায়াং হলো পুতুল নাটকের সবচেয়ে প্রাচীন এবং স্থায়ী রূপগুলোর মধ্যে একটি। ওয়ায়াং সাধারণত কাঠের তৈরি হয় এবং একটি সুতির পর্দার পিছনে নিয়ন্ত্রিত হয়। ওয়ায়াং মূলত ইসলামপূর্ব কিংবদন্তি ঘটনাকে মঞ্চস্থ করে, তবে এটি আমির হামজা-এর মতো ইসলামী মহাকাব্যগুলোর জন্যও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। আমির হামজা ছিলেন মুহাম্মাদ-এর চাচাতো ভাই এবং একজন বীরযোদ্ধা। তার জীবন এবং কাজগুলো ওয়াং নাটকগুলোতে প্রায়শই চিত্রিত করা হয়। তুর্কি ছায়া নাটক কারাগোজ এবং হাজিভাত, অঞ্চলে পুতুল নাটককে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। এই নাটকগুলোতে, কারাগোজ এবং হাজিভাত নামক দুটি চরিত্র একটি হাস্যরসাত্মক এবং সমালোচনামূলক উপায়ে সমাজের বিভিন্ন দিকগুলোকে চিত্রিত করে।[৩৮]
ইসলাম একটি বিশ্বব্যাপী ধর্ম যা বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ভাষার লোকেদের একত্রিত করে। এই বৈচিত্র্য ইসলামী সংগীতেও প্রতিফলিত হয়। বিভিন্ন অঞ্চল এবং সংস্কৃতির মুসলমানরা তাদের নিজস্ব অনন্য বাদ্যযন্ত্রের ঐতিহ্য তৈরি করেছে। সেলজুক তুর্কিরা ইসলামী সংগীতেরবিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তারা আনাতোলিয়ায় আসার পর, তারা তাদের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রের ঐতিহ্যকে স্থানীয় ঐতিহ্যগুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। এই মিশ্রণ থেকে নতুন বাদ্যযন্ত্রের শৈলীর উদ্ভব হয়েছিল যা সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সাহারা-নিম্ন আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং মালয় দ্বীপপুঞ্জে বিশাল মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে। এই অঞ্চলগুলোতে নিজস্ব অনন্য বাদ্যযন্ত্রের ঐতিহ্য রয়েছে যা ইসলামী সংগীতের উপর প্রভাব ফেলেছে। তবে, এই অঞ্চলগুলোর বাদ্যযন্ত্রের ঐতিহ্যগুলো আনাতোলিয়াবা মধ্যপ্রাচ্যের মতো কেন্দ্র থেকে প্রভাবিত হয়নি। সুফিরা ইসলামের একটি আধ্যাত্মিক শাখা যা সঙ্গীতকে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে দেখে। সুফিরা তাদের সংগীতকে ব্যবহার করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের (দিদার) অনুভূতি অর্জনের জন্য। সুফি���ের সংগীত সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটি ইসলামী সংগীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]- ইসলাম
- ইসলামি পরিভাষাকোষ
- মুহাম্মাদ
- কুরআন
- ইসলাম এবং মুসলমান-সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহের সূচীপত্র
- ইসলাম শিক্ষা
- ইসলামের রূপরেখা
- প্রধান ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীসমূহ
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Minds unmade"। The Economist। ৪ মে ২০১৩।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ব্লেয়ার, শিলা এস. এবং জোনাথন এম. ব্লুম। "শিল্প." ইসলাম এবং মুসলিম বিশ্বের বিশ্বকোষ। এড. রিচার্ড সি মার্টিন। ভলিউম ১। নিউ ইয়র্ক: ম্যাকমিলান রেফারেন্স ইউএসএ, ২০০৪। পৃ. ৭৫-৮২। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ "ইসলামিক আর্টস।" ইসলামী বিশ্বের ঐতিহাসিক এটলাস। ডার্বি, যুক্তরাজ্য: কার্টোগ্রাফিকা, ২০০৪। পৃ. ১৭২-১৭৫। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ ক খ এস্পোসিটো, জন এল., সম্পাদক (২০০৩-০১-০১)। ইসলামের অক্সফোর্ড অভিধান (ইংরেজি ভাষায়)। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। আইএসবিএন 978-0-19-512558-0।
- ↑ "কুহনেল, ই. "আরবেস্ক।" ইসলাম এনসাইক্লোপিডিয়া"।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ এস্পোসিটো, জন এল., সম্পাদক (২০০৩-০১-০১)। "ক্যালিগ্রাফি এন্ড এপিগ্রাফি" (ইংরেজি ভাষায়)। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। আইএসবিএন 978-0-19-512558-0।
- ↑ ক খ "ইসলাম ও শিল্প"।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ Esposito, John L., সম্পাদক (২০০৩-০১-০১)। The Oxford Dictionary of Islam (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-512558-0।
- ↑ ক খ এস্পোসিটো, জন এল., সম্পাদক (২০০৩-০১-০১)। ইসলাম ও বিজ্ঞান (ইংরেজি ভাষায়)। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। আইএসবিএন 978-0-19-512558-0।
- ↑ ক খ হিউজ, অ্যারন। "বিজ্ঞান, ইসলাম এবং।" ইসলাম এবং মুসলিম বিশ্বের বিশ্বকোষ। এড. রিচার্ড সি মার্টিন। ভলিউম ২। নিউ ইয়র্ক: ম্যাকমিলান রেফারেন্স ইউএসএ, ২০০৪। পৃ. ৬১১-৬১৪।
- ↑ "ইলম"। ৫ জানুয়ারি ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ অক্টোবর ২০২৩।
- ↑ গ্রান্ট, ই। "বিজ্ঞান (মধ্যযুগে)।" নিউ ক্যাথলিক এনসাইক্লোপিডিয়া। ভলিউম ১২। ২য় সংস্করণ। ডেট্রয়েট: গেল, ২০০৩. ৮০৭-৮১৫। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ ব্রেন্টজেস, সোনজা। "ইসলামী বিজ্ঞান।" ধারণার ইতিহাসের নতুন অভিধান। এড. মেরিয়ান ক্লাইন হরোভিটজ। ভলিউম ৩। ডেট্রয়েট: চার্লস স্ক্রিবনার্স সন্স, ২০০৫। ১১৫৫-১১৬০। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ ক খ পিটার্স, টেড। "বিজ্ঞান এবং ধর্ম।" এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়ন। এড. লিন্ডসে জোন্স। ভলিউম ১২, ২য় সংস্করণ। ডেট্রয়েট: ম্যাকমিলান রেফারেন্স ইউএসএ, ২০০৫। ৮১৮০-৮১৯২। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ শেফার, বডি। "ইসলামিক চিকিৎসা।" ধারণার ইতিহাসের নতুন অভিধান। এড. মেরিয়ান ক্লাইন হরোভিটজ। ভলিউম ৪। ডেট্রয়েট: চার্লস স্ক্রিবনার্স সন্স, ২০০৫। ১৪১২-১৪১৩। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ তাইলান, নেসিপ। "ইসলামী দর্শন"। পৃ. ১৩৬-১৩৮।
- ↑ তাইলান, নেসিপ। পৃ. ১৬৫-২০১।
- ↑ ক খ তাইলান, নেসিপ। পৃ. ২৪৪-২৫৪।
- ↑ তাইলান, নেসিপ। পৃ. ১৪৩।
- ↑ ক খ পিটার্স, টেড। "বিজ্ঞান এবং ধর্ম।" এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়ন। এড লিন্ডসে জোন্স। ভলিউম ১২, ২য় সংস্করণ। ডেট্রয়েট: ম্যাকমিলান রেফারেন্স ইউএসএ, ২০০৫। পৃ. ৮১৮০-৮১৯২। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ গ্রান্ট, ই। "বিজ্ঞান (মধ্যযুগে)।" নিউ ক্যাথলিক এনসাইক্লোপিডিয়া। ভলিউম ১২। ২য় সংস্করণ। ডেট্রয়েট: গেল, ২০০৩। পৃ. ৮০৭-৮১৫। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ ব্রেন্টজেস, সোনজা। "ইসলামী বিজ্ঞান।" ধারণার ইতিহাসের নতুন অভিধান। এড. মেরিয়ান ক্লাইন হরোভিটজ। ভলিউম ৩। ডেট্রয়েট: চার্লস স্ক্রিবনার্স সন্স, ২০০৫। পৃ. ১১৫৫-১১৬০। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ হিউজ, অ্যারন। "বিজ্ঞান, ইসলাম এবং।" ইসলাম এবং মুসলিম বিশ্বের বিশ্বকোষ। এড. রিচার্ড সি মার্টিন। ভলিউম ২। নিউ ইয়র্ক: ম্যাকমিলান রেফারেন্স ইউএসএ, ২০০৪। পৃ. ৬১১-৬১৪। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ ব্রেন্টজেস, সোনজা। "ইসলামী বিজ্ঞান।" এর নতুন অভিধান, দালিনী কাপসায়াক সেকিল্ডেদি। ধারণার ইতিহাস। এড. মেরিয়ান ক্লাইন হরোভিটজ। ভলিউম ৩। ডেট্রয়েট: চার্লস স্ক্রিবনার্স সন্স, ২০০৫। পৃ. ১১৫৫-১১৬০। গেল ভার্চুয়াল রেফারেন্স লাইব্রেরি।
- ↑ জেমস থার্বার, "দ্য উইজার্ড অফ চিটেন্যাঙ্গো", পৃ. ৬৪। ফ্যান্টাসিস্ট অন ফ্যান্টাসিস্ট সম্পাদিত, রবার্ট এইচ. বোয়ার এবং কেনেথ জে. জাহোর্স্কি,
- ↑ মারাশি, মেহদী (১৯৯৪-০১-০১)। উত্তর আমেরিকায় পার্সিয়ান স্টাডিজ: স্টাডিস ইন অনার অফ মোহাম্মদ আলী জাযায়েরি (ইংরেজি ভাষায়)। ইরানবুকস্। আইএসবিএন 978-0-936347-35-6।
- ↑ শিফম্যান, হ্যারল্ড (২০১১-১২-০৯)। আফগানিস্তান এবং এর প্রতিবেশীদের ভাষা নীতি এবং ভাষার দ্বন্দ্ব: ভাষা পছন্দের পরিবর্তনশীল রাজনীতি (ইংরেজি ভাষায়)। ব্রিল। আইএসবিএন 978-90-04-20145-3।
- ↑ ক্যাম্পবেল, জর্জ এল.; কিং, গ্যারেথ (২০২০-০৭-০১)। বিশ্বের ভাষার সংকলন (ইংরেজি ভাষায়)। রাউটলেজ। আইএসবিএন 978-1-136-25846-6।
- ↑ ফ্রাই, আর.এন., "দারি", দ্য এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলাম, ব্রিল পাবলিকেশন্স, সিডি সংস্করণ।
- ↑ উজুন, মেহমেদ (২০০৭) [১৯৯২]। দেশপেকা কিতাবা কুর্দি [কুর্দি সাহিত্যের ভূমিকা] (৫ম সংস্করণ)। ইথাকা এস. ২৩।
- ↑ ক খ গ ঘ আলম, মাহবুবুল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (পঞ্চদশ সংস্করণ)। ৯ বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি।
- ↑ সোহেল, শাহরিয়ার। "নজরুলের সাহিত্য ও ইসলাম"। DailyInqilabOnline (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-২১।
- ↑ সোহেল, শাহরিয়ার। "নজরুলের সাহিত্য ও ইসলাম"। DailyInqilabOnline। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-২১।
- ↑ ওয়াস্টল-ওয়াল্টার, ডরিস (২০১১)। বর্ডার স্টাডিজের অ্যাশগেট রিসার্চ কম্প্যানিয়ন (ইংরেজি ভাষায়)। অ্যাশগেট পাবলিশিং, লি.। আইএসবিএন 978-0-7546-7406-1।
- ↑ হামিত কামাল, উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য তুর্কি সাহিত্য! ইতিহাস, একটি প্রকাশনা, আঙ্কারা ২০০৭
- ↑ ক খ "নিহাদ সামি বানারলি"। Vikipedi (তুর্কি ভাষায়)। ২০২২-১০-২৮।
- ↑ মেরি, জোসেফ ডব্লিউ. (২০০৬)। মধ্যযুগীয় ইসলামী সভ্যতা: একটি বিশ্বকোষ (ইংরেজি ভাষায়)। সাইকোলজি প্রেস। আইএসবিএন 978-0-415-96690-0।
- ↑ মোরেহ (১৯৮৬), "মধ্যযুগীয় ইসলামে লাইভ থিয়েটার", ডেভিড আয়লন, মোশে শ্যারন (সম্পাদনা), স্টাডিজ ইন ইসলামিক হিস্ট্রি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, ব্রিল পাবলিশার্স, এসএস। পৃ. ৫৬৫-৬০১, ISBN 965-264-014-X