জগতজোড়া রহস্যের ভিড়ে আরও কিছু মিশে যাওয়া রহস্য। যা অদ্ভুত, কখনও মানবিক, কখনও অতিমানবীয়, আবার বিশেষ আঙ্গিকে বাস্তব। সেই সব অতীন্দ্রিয়কে এক করে তৈরি হয়েছে এই সংকলন। ২৪টি মৌলিক গল্প লিখেছেন ২৪ জন লেখক-লেখিকা। সীমাবদ্ধতা রাখা হয়নি তাঁদের সৃজনশীলতায়, তাই কিছু গল্প ছোটগল্পের গণ্ডী পেরিয়ে বড়গল্প এমনকি উপন্যাসিকা পর্যায়েও চলে গিয়েছে প্রায়। বিবিধ অতীন্দ্রিয় আঙ্গিকে রচিত গল্পগুলো অলৌকিক গল্প প্রেমীদের নিয়ে যাবে চিরচেনা জগতের বাইরে, ভিন্ন স্তরে।
গল্পতালিকা: ১. তোমার গোপন কথাটি - জুবায়ের আলম ২. নজরদার - কৌশিক মজুমদার ৩. কিচলু ভার্সেস দ্য ওয়ার্ল্ড - শরীফুল হাসান ৪. অরণ্য - তানজীম রহমান ৫. চাঁদের গায়ে ছায়া - মাহরীন ফেরদৌস ৬. কূলযক্ষ - নিলয় নন্দী ৭. রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত - সালমান হক ৮. পহেলা বৈশাখ - লুৎফুল কায়সার ৯. চিত্রকর্ম - ইশরাক অর্ণব ১০. ডেড এন্ড - আফরিন মৌ ১১. সাক্ষী - বাপ্পী খান ১২. ���াসভূমি - কৌশিক জামান ১৩. পৃথিবীর সব ধ্বনি, সব রঙ মুছে গেলে পর - ওয়াসি আহমেদ ১৪. বৈকালিক ভ্রমণ - অসীম পিয়াস ১৫. মানোবট্রন - তানজিরুল ইসলাম ১৬. রাত দশটার ইংরেজি খবরের পরে - নাবিল মুহতাসিম ১৭. নির্মল বাবুর আয়না - জাহিদ হোসেন ১৮. শাপমোচন কিংবা শরীর পাতন - যারিন তাসনিম প্রমি ১৯. খোয়াবনামা - আবরার আবীর ২০. ঈশ্বরের প্রতিরূপ - তাওসীফ আহমেদ ২১. নিশি - সিদ্দিক আহমেদ ২২. বারি হারাতা - সাঈদ শিহাব ২৩. চিত্রকর ও নারী চতুষ্টয় - দীপিকা মজুমদার ২৪. একটি পরিবর্তনের ইতিকথা - প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার
Passionate about writing. The prior stories and poems were published in several magazines throughout years. First book was published in 2013. The next book was also at the same year. Both were collaboration work with other writers in story collections.
First novel was published in 2014, in Bangladesh.
Currently working on several novels, in various genres.
শেষ কবে বাংলায় এত ভালো একটা মৌলিক অতিপ্রাকৃত গল্পের সংকলন পড়েছি মনে পড়লো না।
সংকলনের সেরা গল্প তানজীম রহমানের "অরণ্য"। মধ্যযুগের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধফেরত এক সৈন্যর অদ্ভুত বনে অতিপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞতার কাহিনি। বিষন্ন ভয়াবহ পরিবেশ, ভয়াল অনুভূতি, অন্ধকার সব দৃশ্যকল্প সব মিলিয়ে রীতিমতো মুগ্ধ করার মত গল্প।
জুবায়ের আলমের মোবাইলে অচেনা শক্তির সাথে কথোপকথনের গল্প " তোমার গোপন কথাটির" প্লট পুরোনো ধাঁচের হলেও চমৎকার বর্ণনার জোরে উৎরে গিয়েছে।
কৌশিক মজুমদারের নিজের পরিবর্তনের গল্প "নজরদার" পুরোপুরি অতিপ্রাকৃত গল্প বলে মনে না হলেও কাহিনি হিসেবে যথেষ্ঠ ইন্টারেস্টিং।
শরীফুল হাসানের "কিচুল ভার্সেস দ্য ওয়ার্ল্ড" পড়ে বেশ মজা পেয়েছি, জোম্বি আর হিউমারের মিশেলটা দুর্দান্ত ছিল, শেষটা এরকম খাপছাড়া না হলে দুর্ধর্ষ একটা গল্প হত।
মাহরীন ফেরদৌসের পুরাকালের প্রেক্ষাপটের গল্প "চাঁদের গায়ে ছায়া" শুরুটা ভালো করে শেষ পর্যন্ত আর ধরে রাখতে পারেনি।
নিলয় নন্দীর "কূলযক্ষ" বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ঢাকার পরিবেশটা ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেনি, আরো বড় পরিসরে পরিবেশ আর চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুললে গল্পটা চমৎকার হত।
সালমান হকের পৌরাণিক প্রেক্ষাপটের অলৌকিক গল্প "রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত" ভালো লেগেছে, তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই গল্পের ক্যানভাস আসলে উপন্যাসিকার উপযোগী।
লুৎফুল কায়সারের গল্প "পহেলা বৈশাখ" গড়পড়তা, সেই চিরাচরিত ভূতের গল্পের ফর্মুলা, শেষে এসে বের হয় যাকে মানুষ মনে হচ্ছিল সে আসলে ভূত। অসীম পিয়াসের "বৈকালিক ভ্রমণ" একই ফর্মুলার গল্প হলেও বর্ণনার কারণে বেশ উপভোগ্য। ইশরাক অর্নবের "চিত্রকর্ম" গল্পটাও শেষমেশ ঠিক জমলো না।
সংকলনের সবচেয়ে বাজে গল্প আফরিন মৌ এর কিচ্ছু হয়নি টাইপ প্রেম, জাদু, নরকের প্রহরী, কুড়িয়ে আনা সন্তান, বন্ধুত্ব, কুকুর সবমিলিয়ে খিচুড়ি গল্প "ডেড এন্ড"। কাহিনি, চরিত্র, ভাষা, বর্ণনা একটার চেয়ে আরেকটা খারাপ। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হল এটা আবার সংকলনের সবচেয়ে বড় গল্প।
বাপ্পী খানের "সাক্ষী" অন্যতম সেরা গল্প। দূর পাহাড়ের গহীন বনের পটভূমিকায় ভয়ংকর অতিপ্রাকৃতিক শক্তির উপস্থিতির গল্প মুগ্ধ করার মত। সাঈদ শিহাবের আদিবাসী গ্রামের অপদেবতার গল্প "বারি হারাতা"ও একই পরিবেশের, কাহিনি আর বর্ণনার জোরে এই গল্পটাও অনেক ভালো লেগেছে।
কৌশিক জামানের "ঘাসভূমি" গল্পটাও সুন্দর, আরেকটু বড় হলে দুর্দান্ত হত।
ওয়াসি আহমেদ "পৃথিবীর সব ধ্বনি, সব রং মুছে গেলে পর" আরেকটা সেই লেভেলের দুর্ধর্ষ গল্প। কাহিনীর নতুনত্ব, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা সর্বগ্রাসী অন্ধকারের দম বন্ধ করা বর্ণনা আর অমোঘ পরিণতির এই গল্প মনে রীতিমতো দাগ কেটে যায়। সংকলনের দ্বিতীয় সেরা গল্প।
তানজিরুল ইসলামের "মনোবট্রন" ভালো লাগেনি। অতিপ্রাকৃতিক রহস্যময়তা দিয়ে শুরু করেও শেষমেশ মানবিক অনুভূতির গল্প হয়ে গিয়েছে।
নাবিল মুহতাসিমের "রাত দশটার ইংরেজি খবরের পরে" জাস্ট ওয়াও একটা গল্প। খুবই ভালো লেগেছে পড়ে। শৈশবের লুকিয়ে থাকা অন্ধকার জগতের উত্থানের সেই লেভেলের একটা গল্প।
তাওসীফ আহমেদের "ঈশ্বরের প্রতিরূপ" নতুন কনসেপ্ট এর কারণে ভালো লেগেছে।
সিদ্দিক আহমেদের "নিশি" বাজে গল্পের দিক দিয়ে দ্বিতীয়। জোড়াতালি দেওয়া একটা গল্প।
দীপিকা মজুমদারের "চিত্রকর আর নারী চতুষ্টয়" অনেক ভালো লেগেছে।
সংকলনের শেষ এবং তৃতীয় সেরা গল্প প্রান্ত ঘোষ দস্তিদারের "একটি পরিবর্তনের ইতিকথা"। একটা সাদামাটা আটপৌরে পরিবারের সাংসারিক টানাপোড়েনের কাহিনি যেভাবে একটা দুর্দান্ত অতিপ্রাকৃতিক কাহিনীতে মোড় নিল সেটা রীতিমতো মুগ্ধ করার মত। কাহিনির পাশাপাশি ভাষা আর চরিত্র দুইটাই শক্তিশালী।
গল্পগুলোর সম্পাদনাও বেশ ভালো। খুব কম দুই একটা ব্যতিক্রম ছাড়া বানান ভূল প্রায় নেই বললেই চলে। প্রতিটা গল্পের নামের ইলাস্ট্রেশনও বেশ লেগেছে।
২৪ জন লেখকের ২৪টা অতিপ্রাকৃত গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে 'অতীন্দ্রিয়' অতিপ্রাকৃত গল্প সঙ্কলনটা। প্রত্যেকটা গল্পই মৌলিক। এই সঙ্কলনের সম্পাদনা করেছেন প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার ও সালমান হক। নানা স্বাদের এই গল্পগুলোর মধ্যে কয়েকটা গল্প নিয়ে নিচে আলোচনা করছি। স্বাভাবিকভাবেই রিভিউটা বড় হতে যাচ্ছে। যারা পড়বেন, ধৈর্য ধরে পড়বেন।
তোমার গোপন কথাটি - জুবায়ের আলমঃ রাশিক সাহেব একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড স্মার্টফোন কিনেছেন। সেই স্মার্টফোনে হঠাৎ-ই এক রাতে এক অপরিচিত কিশোরী ভিডিও কল দেয়। রাশিক সাহেবের সাথে শুরু হয় সেই কিশোরীর কথোপকথন। মেয়েটা তাঁকে তাঁর কলিগদের সম্পর্কে গোপনীয় কিছু তথ্য দেয় আর শর্ত দেয় সেগুলো গোপন রাখার। আর ঠিক এরপর থেকেই পাল্টে যায় রাশিক সাহেবের জীবন।
বইয়ের প্রথম গল্প এটা। মো���া���ুটি ভালোই লেগেছে আমার কাছে। কিন্তু অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পাইনি। কিছু ভুলভ্রান্তিও খেয়াল করেছি। একটা জায়গায় মেয়েটা-এর বদলে লেখা হয়েছে ছেলেটা, সৌমেন সাহেব-কে লেখা হয়েছে সৌমিনে সাহেব, উপহার সিনেমা হল-এর বদলে লেখা হয়েছে উপশহর সিনেমা হল। ছোট একটা গল্পে এরকম ভুল কিভাবে থাকে, বুঝলাম না।
নজরদার - কৌশিক মজুমদারঃ স্কুলপড়ুয়া এক কিশোর, যাকে কি-না মিশনারী স্কুল থেকে রাস্টিকেট করা হয়েছে শিক্ষিকাকে আক্রমণ করার অভিযোগে। মদ্যপ বাবা ছাড়া ছেলেটার আর কেউ নেই। স্বাভাবিকভাবেই কুসঙ্গে পড়লো ছেলেটা। স্বভাব ও চরিত্র ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকলো। ছেলেটার একটা অদ্ভুত সমস্যা আছে। আর তা হলো, বিশেষ বিশেষ সময়ে সে তার আশেপাশে একজন অচেনা মানুষকে দেখতে পায় যার এক চোখ ফুলে বন্ধ হয়ে গেছে, আরেক চোখ খোলা। বাটি ছাঁট দেয়া চুলের লোকটা ঠিক তার দিকেই এক চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। আর এটা ঘটে যখন সে কোন বিপদে পড়ে বা পড়তে যাচ্ছে। রহস্যটা কি আসলে?
ওপার বাংলার এসময়কার জনপ্রিয় লেখক কৌশিক মজুমদারের চমৎকার একটা গল্প 'নজরদার'। বেশ ভালো লেগেছে আমার কাছে গল্পটা।
কিচলু ভার্সেস দ্য ওয়ার্ল্ড - শরীফুল হাসানঃ ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে কিছু জোম্বির কবলে পড়লো কন্ট্রাক্ট কিলার কিচলু ও তার সহকারী মফিজ। অবস্থা এমন যে, জোম্বিদের কামড় খেয়��� জোম্বি হওয়া ছাড়া ওদের আর কোন গতি নেই। ঠিক এমন সময় ওদের সাক্ষাৎ এক মোটরসাইকেল আরোহী ও এক রহস্যময় বৃদ্ধের সাথে। কারা এরা? শেষমেষ কি কিচলু আর মফিজ বাঁচতে পারবে, নাকি পরিণত হবে জিন্দালাশে?
সুলেখক শরীফুল হাসানের ব্যতিক্রমধর্মী একটা গল্প 'কিচলু ভার্সেস দ্য ওয়ার্ল্ড'। বাংলায় জোম্বি বিষয়ক কোন মৌলিক লেখা এর আগে পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। বেশ ভালো লেগেছে গল্পটা।
অরণ্য - তানজীম রহমানঃ মৃত সহযোদ্ধার লাশ সাথে নিয়ে রাজধানীতে ফিরছে এক সৈনিক। প্রচণ্ড ঠান্ডা আর সেইসাথে ভয়াবহ তুষ���রপাত হচ্ছে। রাস্তা একটু সংক্ষিপ্ত করার জন্য একটা রহস্যময় বনের ভেতর দিয়ে চলা শুরু করলো সৈনিক। কিন্তু বনটা যেন দুঃস্বপ্নেরই কোন এক দুনিয়ার অংশ। কি নড়ছে ওই গর্ভবতী ঘোড়ার পেটের ভেতরে? আলখেল্লা জড়ানো প্রাণীটা কি আসলেই মানুষ, নাকি অন্যকিছু? তুষারের স্তুপ ঠেলে উঠে এলো এক শেকলে বাঁধা বুড়ি। পুরো বন যেন সৈনিককে বলছে, "দিয়ে যাও!" কি চায় ওরা?
অসাধারণ একটা হরর গল্প। ভয়ের অনেক উপাদান আছে সুলেখক তানজীম রহমানের এই গল্পে। হরর বড় গল্প হিসেবে পারফেক্ট, আমার মতে। এই সঙ্কলনের অন্যতম সেরা গল্প 'অরণ্য'।
কূলযক্ষ - নিলয় নন্দীঃ ১০০ বছর আগের ঢাকা। বিপিন নামের এক যুবক তার বন্ধু ইমামের শরণাপন্ন হয়। বিপিনদের শতবর্ষী বাড়িতে উৎপাত শুরু করেছে কূলযক্ষ নামের এক প্রাচীন ও ভয়ঙ্কর অপদেবতা। বন্দি অবস্থা থেকে ছাড়া পেয়ে এখন শুধু বিপিনদের বাড়িরই না বরং পুরো শহরের অনিষ্ট করার অভিপ্রায় নিয়ে আছে অপদেবতাটা। এমতাবস্থায় ইমাম কিভাবে সাহায্য করবে বিপিনকে?
১০০ বছর আগের ঢাকাকে বেশ চমৎকারভাবে নিলয় নন্দী ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর এই গল্পে। ছোট গল্পটা বেশ ভালো লেগেছে আমার। আর লেখকের গল্প বলার ধরণটাও অসাধারণ লেগেছে।
রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত - সালমান হকঃ বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা অতিপ্রাকৃত গল্পের একটা সঙ্কলনের সম্পাদনা করতে গিয়ে এক ব্যক্তির হাতে এসে পড়ে একটা অদ্ভুত গল্প। ডায়েরি আকারে লেখা গল্পটা রীতিমতো চমকপ্রদ। মানস নামের এক ছেলে হঠাৎ আবিস্কার করে তার সাদাসিধে বাবার জীবনে একটা লুকানো অধ্যায় আছে। উনি গোপনে একটা পোড়োবাড়িতে গিয়ে কিছু একটা করেন। স্ফটিকের ভেতরের এক দেবীমূর্তি সেই রহস্য আরো ঘনীভূত করেন। কে এই নেসহাত? নেরহাত কি চায়? আর শানযাবের পুনরুত্থান কি আসলেই হবে?
'অতীন্দ্রিয়' সঙ্কলনের অন্যতম সেরা গল্প 'রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত'। সালমান হক তাঁর এই গল্পে অতিপ্রাকৃত আবহটা সৃষ্টি করেছেন চমৎকারভাবে। আর সমাপ্তিটাও দারুণ ছিলো। একটা ভুল চোখে পড়েছে। ৬ আর ৭-এর মধ্যে লেখক গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছেন এক জায়গায়। আর ঢুকে পড়া কথাটাকে বারবার ঢুঁকে পড়া লেখা দেখে সামান্য বিরক্ত হয়েছি গল্পটা পড়তে গিয়ে।
সাক্ষী - বাপ্পী খানঃ 'সত্যকলাম' পত্রিকায় সদ্য যোগ দেয়া সাংবাদিক ফারুক দুই দিনের ছুটিতে গারো পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে ফিরলো সাত দিন পর। আর ফিরেই সে শোনালো এক অবিশ্বাস্য গল্প। রাতারাতি পাহাড়ি জঙ্গলের ভেতরে গজিয়ে উঠেছে এক রহস্যময় পুকুর। সেই পুকুরে আছে ভয়ঙ্কর কোনকিছু, যা প্রাণনাশ করে চলেছে একের পর এক মানুষের।
মোটামুটি ধরণের গল্প। কিছুটা অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছে একটা অংশ। পানিতে ঠায় দাঁড়িয়ে কেউ গায়ে আগুন দিনে কোনরকম ছটফট না করে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে মরে যাওয়াটা অযৌক্তিক লেগেছে। তাড়াহুড়ার ছাপ ছিলো 'সাক্ষী'-তে।
পৃথিবীর সব ধ্বনি, সব রঙ মুছে গেলে পর - ওয়াসি আহমেদঃ একসময়ের জনপ্রিয় একজন লেখক বেশ কয়েক বছর হলো কিছু লিখতে পারছেন না। তাই একজনের পরামর্শে তিনি ডায়েরি লেখা শুরু করলেন। লেখক সাহেবের সাথে হঠাৎ করেই অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। ভয়াবহ কিছু দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন তিনি। জীবন থেকে সব রঙ হারিয়ে গেলো। ধূসর এক পৃথিবীতে বন্দি হয়ে গেলেন তিনি। মাকড়শা আর মাকড়শার জালে ছেয়ে যেতে লাগলো তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব। দুঃস্বপ্নগুলো হয়ে উঠতে লাগলো আরো ভয়াবহ।
বেশ ইন্টারেস্টিং ও ভয় জাগানিয়া একটা গল্প। ওয়াসি আহমেদ তাঁর এই গল্পে দুঃস্বপ্নের যে জগতের মুখোমুখি করেছেন আমাকে, তা কল্পনা করলে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। বেশ ভালো লেগেছে গল্পটা। আমার মতে এই সঙ্কলনের আরো একটা সেরা গল্প এটা।
বৈকালিক ভ্রমণ - অসীম পিয়াসঃ নতুন এলাকায়, নতুন বাসায় ওঠার পর এক বিকেলে জিসান বের হলো আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখতে। গাছগাছালির ছায়াঢাকা একটা সরু রাস্তা, একটা খাল আর তার ওপরে একটা পুল আবিস্কার করলো সে। শান্ত পরিবেশ। ঘুরতে ঘুরতে ওর সাথে পরিচয় হলো আরাফাত নামের এক ছেলের। সে জিসানকে শোনালো রহস্যময় এক সাইকেলওয়ালার গল্প। আর সেই গল্পের শেষেই যেন পাল্টে গেলো সব হিসাবনিকাশ।
ছোট গল্পটা অসাধারণ লেগেছে আমার। গল্পের শেষে একটা ধাক্কা খেয়েছি। দুটো ভুল খেয়াল করেছি। এক জায়গায় খাল-কে নদী লেখা হয়েছে। আর শেষ দিকে জিসান-কে লেখা হয়েছে জিহান।
রাত দশটার ইংরেজি খবরের পরে - নাবিল মুহতাসিমঃ বহুদিন পর নিজের ছোটবেলার শহর রংপুরে ফিরে এসেছেন রূপুর কাছের বড় ভাই আলম। রূপুকে সাথে নিয়ে নিজের শৈশবের মহল্লাটা ঘুরছেন আলম ভাই। সেই সাথে চলছে স্মৃতিচারণ। কিন্তু রূপু খেয়াল করলো, মানুষটার আচরণ কেমন যেন উদভ্রান্ত। সন্ধ্যায় নিজেদের চিরচেনা স্কুলমাঠে দাঁড়িয়ে আলম ভাইয়ের গল্প শোনার সময় সে আবিস্কার করলো কোন একটা কিছু একেবারেই ঠিক নেই। ভয়াবহ কিছু ঘটতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই।
বেশ ভয়ের একটা গল্প এটা। লেখকের বর্ণনাভঙ্গির কারণে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিলো গল্পটা। গল্পের চরিত্রদের সাথে আমিও কিছু সময়ের জন্য ফিরে গেছিলাম নব্বইয়ের দশকে। আহারে শৈশব! আহারে স্মৃতি!
শাপমোচন কিংবা শরীর পাতন - যারিন তাসনিম প্রমিঃ বন্ধুর কাছে বেড়াতে এসে সুন্দরবনের কোলঘেঁষা এক ছোট্ট গ্রামে শংকর বাউয়ালির খোঁজ পেলো ওয়াহিদ, রিয়াদ আর মিনহাজ। বৃদ্ধ এই বাউয়ালি নাকি অতিথিসৎকারে সেরা। তার বাড়িতে থেকে আশেপাশের অঞ্চলটা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলো তিন বন্ধু। কিন্তু বাউয়ালির যুবতী স্ত্রী অহল্যার মদির আহবানে বাঁধা পড়ে গেলো ওয়াহিদ। এদিকে গ্রামে ঘনিয়ে আসছে তাদের ইষ্টদেবী বেহুকীর বাৎসরিক পূজার সময়। কি এমন দেখেছিলো ওরা সেদিন?
এই সঙ্কলনে আমার পড়া সবচেয়ে ভালো লাগা গল্প এটা। লেখিকার গল্প বলার ধরণটা চমৎকার লেগেছে। পুরো গল্পটাই শ্বাসরুদ্ধকর ছিলো। ভয়ের উপাদানেরও কোন কমতি লক্ষ্য করিনি। গল্পটা শেষ করার পর আফসোস হয়েছে এই ভেবে যে এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো কেন!
ঈশ্বরের প্রতিরূপ - ওয়াসীফ আহমেদঃ ২০৭৬ সালের ঢাকা। শহরজুড়ে নেমে এসেছে তীব্র শীত। প্রচুর বরফ পড়ছে। প্রবল শীতের কারণে জনজীবন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত আর দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। ঠিক এমনই সময় এক পরিবারে এক রহস্যময় অতিথির কৃপায় এলো এক গরু। সেই গরু জন্ম দিলো এমন এক প্রাণীর, যার মাংস কেটে নিলেও সে মরে না৷ অদ্ভুত এই প্রাণীই জন্ম দিলো ভয়াবহ এক রহস্যের।
অদ্ভুত একটা গল্প। কিছু জায়গায় বর্ণনা বেশ ডিস্টার্বিং লেগেছে। তবে উপভোগ্য ছিলো পুরো গল্পটা। লেখক চমৎকার লিখেছেন। ওয়াসীফ আহমেদের কোন লেখা এর আগে পড়ার সুযোগ হয়নি। ভবিষ্যতে আশা করি তিনি আরো লিখবেন।
নিশি - সিদ্দিক আহমেদঃ জমিদারপুত্র নিজাম এসেছে তাদের জমিদারির এক মহাল পরিদর্শনে। সেই মহালের একটা অংশে রয়েছে ব���শাল এক আমবাগান ও সেই সংলগ্ন এক প্রাচীণ মন্দির ও দীঘি। সেই দীঘি আর মন্দির নিয়ে মহালের মানুষদের ভেতরে রয়েছে এক চাপা আতঙ্ক। নিজামের জীবনেও রহস্যের আগমন ঘটলো। সাদা শাড়ি পরা এই ষোড়শী তরুণীকে সে দেখতে লাগলো তার আশেপাশে। সাবেক জমিদার নিকুম্ব ঘোষের মেয়েটার ভাগ্যে আসলে কি ঘটেছিলো, সেটার উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিজাম আবিস্কার করলো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার মতো কিছু সত্য।
চমৎকার একটা গল্প 'নিশি'। সিদ্দিক আহমেদের লেখা বরাবরই ভালো লাগে। এই গল্পটাও বেশ উপভোগ করেছি পড়ার সময়। পুরোনো সময়কে উপজীব্য করে লেখা অতিপ্রাকৃত গল্পের আবেদন সবসময়ই আমার কাছে অন্যরকম। ভুল ছিলো কিছু। এক জায়গায় জমিদার নিকুম্ব ঘোষ-কে লেখা হয়েছে নিকুম্�� চৌধুরী। আর এক জায়গায় একটা চরিত্রের নাম ওলটপালট হয়ে গেছে। যাই হোক, 'নিশি' এই সঙ্কলনের অন্যতম সেরা গল্প।
একটি পরিবর্তনের ইতিকথা - প্রান্ত ঘোষ দস্তিদারঃ স্ত্রী সুমাত্রি ও একমাত্র মেয়ে মিলিকে নিয়ে ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিলো লোকটার। কিন্তু তার মনে একটা বিষয় কাঁটার মতো বিঁধেই ছিলো। বিষয়টা হলো, শাশুড়ির সাথে সুমাত্রির ঝামেলা। এই ঝামেলার কারণেই লোকটাকে বেছে নিতে হলো স্ত্রী ও মেয়েক��। বাদ পড়লেন মা। একদিন লোকটার মা রীতি নামের এক অনাথ মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হলেন তার বাড়িতে। আর এরপর থেকেই ঘটতে শুরু করলো অদ্ভুত কিছু ঘটনা। মিলি ও সুমাত্রির চিরচেনা স্বভাব ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করলো। এমনকি বদলে যেতে শুরু করলো লোকটা নিজেও। কেন এই পরিবর্তন? আর এর শেষই বা কোথায়?
মোটামুটি ভালোই লেগেছে প্রান্ত ঘোষ দস্তিদারের এই বড় গল্পটা। ব্যতিক্রমধর্মী একটা প্লট নিয়ে লেখক লিখেছেন। প্রাচীণ ধর্ম আর গুপ্তসংঘ-এর মতো ব্যাপারগুলো থাকায় আগ্রহ আরো বেড়ে গেছিলো পড়ার সময়।
এই গল্পগুলো ছাড়াও 'অতীন্দ্রিয়'-তে আরো আছে মাহরীন ফেরদৌসের 'চাঁদের গায়ে ছায়া', লুৎফুল কায়সারের 'পহেলা বৈশাখ', ইশরাক অর্ণবের 'চিত্রকর্ম', আফরিন মৌয়ের 'ডেড এন্ড', কৌশিক জামানের 'ঘাসভূমি', তানজিরুল ইসলামের 'মানোবট্রন', জাহিদ হোসেনের 'নির্মল বাবুর আয়না', আবরার আবীরের 'খোয়াবনামা', সাঈদ শিহাবের 'বারি হারাতা' ও দীপিকা মজুমদারের 'চিত্রকর ও নারী চতুষ্টয়' গল্প গুলো। ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের এই অতিপ্রাকৃত গল্পগুলোর সাথে সময় ভালোভাবেই কেটেছে। যদিও ব্যক্তিগত ঢিলেমির কারণে সবগুলো গল্প পড়ে শেষ করতে অনেক বেশি সময় লেগে গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে।
'অতীন্দ্রিয়'-এর সাফল্যের পর প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার ও সালমান হকের সম্পাদনায় আফসার ব্রাদার্স থেকে সামনেই আসছে আরো একটা অতিপ্রাকৃত গল্প সঙ্কলন, যার নাম হবে সম্ভবত 'অলৌকিক'। সেটার অপেক্ষায় রইলাম।
বইটার প্রচ্ছদ বেশ ভালো লেগেছে আমার। বাঁধাই আর কাগজের মানও চমৎকার ছিলো।
যারা অতিপ্রাকৃত গল্প পছন্দ করেন, তারা চাইলে পড়তে পারেন 'অতীন্দ্রিয়'।
বিভিন্ন লেখকের লেখা নিয়ে হওয়া সঙ্কলন পড়ার সার্থকতা এটাই - আস্থার লেখক খুঁজে পাওয়া যায়, সবার লেখার নমুনা দেখে সিদ্ধান্তে আসা যায় কোনো লেখকের আরো কাজ নেড়েঘেঁটে দেখব কি না। তাঁর মাঝে 'অতীন্দ্রিয়' একটু ভিন্নধারার কাজ করেছে, অতিপ্রাকৃত গল্পের সঙ্কলন বের করেছে, যে জনরায় লেখার আগ্রহ হারাচ্ছেন বর্তমান প���ঠকেরা, আপাতদৃষ্টিতে। মজার ব্যাপার হলো অতীন্দ্রিয়তে যারা লিখেছেন তাদের অধিকাংশই অতিপ্রাকৃতে লেখার জন্য পরিচিত না। এই যেমন নাবিল মুহতাসিম ব্রেক-থ্রু করেছেন এসপিওনাজ জনরায়, পয়লা বই 'শ্বাপদ সনে' অতিপ্রাকৃত এলিমেন্ট ব্যবহার করলেও পাঠকের কাছে তিনি এখন থ্রিলার-লেখক। আবার সিদ্দিক আহমেদ। ঐতিহাসিক উপন্যাস বা অল্টারনেট হিস্টরি জনরায় তুমুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর স্ক্রিপ্টে তৈরী অতিপ্রাকৃত সিরিজ 'সুন্দরী'র কথা সব পাঠক হয়তো বলেন না। জুবায়ের আলম, শরীফুল হাসান, এমন অনেককেই এই তালিকায় ফেলা যায়, আবার নিয়মিত অতিপ্রাকৃত জনরায় লেখা মানুষরাও আছেন, যেমন তানজীম রহমান কিংবা লুৎফুল কায়সার।
কথা না বাড়িয়ে বরং ২৪ জন লেখকের মোট ২৪টা লেখার মাঝ থেকে আমার পছন্দ হওয়া ১০টা গল্প সম্পর্কে বলে যাই-
(১) তোমার গোপন কথাটি - জুবায়ের আলম : প্রযুক্তির ব্যবহারে ন্যুব্জ বর্তমান সময়ে অতিপ্রাকৃতকে মিলিয়েছেন লেখক। রাশিক নামের ভদ্রলোক ফোন হারিয়ে চোরাই ফোনবিক্রেতার কাছ থেকে নতুন মোবাইলসেট কেনার পর গল্প শুরু হয়। লিনিয়ার, আবেশী।
(২) নজরদার - কৌশিক মজুমদার : এই ধাঁচের গল্প অতিপ্রাকৃত জনরায় অনেক ঘুরেফিরে এসেছে, উদাহরণ টানতে পারলাম না। সাধারণ জীবনের টানটান গল্পের মাঝে অতিপ্রাকৃত এসে উঁকি দেয়। চমৎকার কাজ, স্টোরিটেলিং গল্প পড়তে বাধ্য করবে।
(৩) কূলযক্ষ - নিলয় নন্দী : বৈচিত্রময় লেখক নিলয় নন্দী নানান জনরায় খুবই দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাঁর লেখা আমরা আরো নিয়মিত পাই না। ব্রিটিশ আমলে তন্ত্রসাধন, অভিজাত পরিবার আর যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা অভিশাপ, নিষ্পত্তি, এসব নিয়ে গল্পের নির্মাণ। বইয়ের অন্যতম ভাল কাজ।
(৪) রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত - সালমান হক : এই বয়ের একেবারে ভিন্ন স্বাদের একটা গল্প। 'তুম্বাড়' সিনেমার আবহ পেয়েছি খানিকটা। A story that relates the forgotten old Gods.
(৫) চিত্রকর্ম - ইশরাক অর্ণব : ছোট্ট গল্পটা হাত থেকে বই রাখতে দিবেনা আপনাকে। শিল্পের মাঝে নিজেকে উৎসর্গ করার অনবদ্য একটা গল্প। The Anguished Man ছবিটার কথা মনে পড়েছে এটা পড়ে, যে ছবিটা শিল্পী নিজের রক্তে একেছিলেন, শিল্পীর কোনো পরিচয় জানা যায়নি।
(৬) রাত দশটার ইংরেজি খবরের পরে - নাবিল মুহতাসিম : যদি গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো গল্প চান, তাইলে এই গল্পটাই সবথেকে উপযুক্ত। শহরতলীর প্রেক্ষাপট, অনেকখানি নস্টালজিয়া ভরা নব্বইয়ের দশকের স্মৃতি প্রচন্ড ভয়াবহতায় রূপ নিয়েছে এই গল্পতে, শিউরে উঠেছিলয়াম কেবল এটা পড়েই।
(৭) নির্মল বাবুর আয়না - জাহিদ হোসেন : লেখকের প্রিয়-অপ্রিয় অনেক লেখা আছে, তবে এই গল্পটা প্রিয়র মাঝে পড়বে। গল্পের মাঝে গল্প বলে পাঠককে চোস্ত হয়ে আসরে বসিয়ে রেখেছেন লেখক, আর দারুণ ট্যুইস্ট দিয়ে গল্প শেষ করেছেন। এমনকি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন স্বয়ং জাহিদ হোসেনকেও - বাস্তবের, নাকি গল্পের গল্পলেখক জাহিদ হোসেন, তা আমরা জানি না।
(৮) নিশি - সিদ্দিক আহমেদ : ইদানীং সিদ্দিক আহমেদের লেখা পড়লেই মনে হয় 'এটা খুব ভাল চিত্রনাট্য হবে'। এই গল্পটাও তেমনই একটা। ইংরেজ আমলের জমিদার বাড়ির প্রেক্ষাপটে গা ছমছমে এক গল্প লিখে গেছেন লেখক, সারাটাক্ষণ চোখে ভেসেছিল যার দৃশ্যপট। এটা সেসব গল্পের একটা যেটা পড়ে ঘরের খুলে রাখা জানলার দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হবার প্রবণতা হবে আপনার।
(৯) শাপমোচন কিংবা শরীর পাতন - যারিন তাসনিম প্রমি : মোক্ষম একটা গল্প! সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে বাওয়ালিদের বিচ্ছিন্ন গ্রামে নিজস্ব আচার অনুষ্ঠানের খপ্পরে পড়া কয়েক আগ্রহী তরুণের গল্প। হলিউড সিনেমায় এমনটা দেখে থাকি আমরা Cabin in the Woods-এর মতো সিনেমায়। দুঃখিত, খ���বই দুর্বল যোগসূত্র টানা হলো সেটা। তবে ভরপুর এডভেঞ্চারাস একটা গল্প।
(১০) একটি পরিবর্তনের ইতিকথা - প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার : সব সঙ্কলনে একটা মুকুটসম গল্প থাকে। এই বইয়ের জন্য এটাই সেটা। ৩২ পেইজের বড়সড় গল্পটা ধীরে ধীরে নির্মিত হয়েছে, আস্তে আস্তে তাঁর আবহে পাঠককে জড়িয়ে নিয়েছে, সাধারণ জীবনের গল্পের মাঝে একটু একটু করে অতিপ্রাকৃত উপাদানগুলোও স্বাভাবিক, সহজ হয়ে উঠেছে, গল্পের ভেতর যেমন ঘটেছে তেমনই। চমৎকার একটা স্লো-বার্ন গল্প। আর পরিসমাপ্তির মাঝেও খানিকটা ওপেন এন্ডিং রেখে পাঠককে প্রশ্নের মাঝে ছেড়ে গেছেন।
সঙ্কলনে বেশ এমন কিছু কাজ ছিল, যেগুলো ঠিক আমার জনরার না বা উপভোগ করতে পারিনি দুর্ভাগ্যক্রমে। বর্তমানের সবথেকে পরীক্ষামূলক লেখালেখি করা একজন লেখক, তানজীম রহমানের 'অরণ্য' গল্পটা হজম করতে পারিনি। ওয়াসি আহমেদ রাফির লেখা বেশকিছু লেখা আমার পছন্দের তালিকায় আছে। 'পৃথিবীর সব ধ্বনি, সব রং মুছে গেলে পর' দুর্দান্ত উইয়ার্ড একটা গল্প, কোনো কারণে উপভোগ করতে পারিনি।
আফরিন মৌ আপুর 'ডেড এন্ড' পড়ে সত্যি আগ্রহী হয়েছি তাঁর আর লেখা থাকলে পড়ে দেখব বলে। আমি নিশ্চিত ছিলাম ওই ইউনিভার্সে সিঙ্গল প্রটাগনিস���ট���িত্তিক বুকসিরিজ লিখবেন বা লিখছেন উনি।
দীপিকা মজুমদারের 'চিত্রকর ও নারী চতুষ্টয়' একটা বেশ ভালো গল্প ছিল। আরেকটা এডভেঞ্চার-ধর্মী দু���্দান্ত গল্প ছিল সাইদ শিহাবের 'বারি হারাতা'। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে অপদেবতা নিয়ে এমন লেখা সচরাচর চোখে পড়েনি। আফরিন মৌ, আর সাইদ শিহাব, নতুন করে যদি কোনো লেখকের লেখা পড়তে আগ্রহী হয়ে থাকি 'অতীন্দ্রিয়' পড়ে, তবে এই দুজন হবে আমার পাওয়া।
প্রতিদিনকার বোরিং জীবন থেকে একটুখানি ব্রেক নেওয়ার আমার একটা টোটকা হলো ছোটগল্প পড়া। যদি তা হয় ভৌতিক জনরার তাহলে তো কথাই নেই।কিন্তু রয়েসয়ে গল্পসংকলন পড়তেই বেশি উপভোগ করি। ছোটগল্প পড়ে দ্রুত শেষও হয় আবার ভালো একটা গল্প হলে মনটাও ভালো হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যে। বইয়ে ২৪টা গল্প আছে ২৪জন লেখকের। তবে মজার বিষয় হলো এই সংকলন শেষ করতে একবছরেও বেশি সময় নিয়েছি। যখন ইচ্ছে হয়েছে পড়েছি আরকি। তাই যখন রিভিউ লিখতে বসছি কিছু গল্প আবার উল্টেপাল্টে দেখতে হয়েছে।
১। তোমার গোপন কথাটি — জুবায়ের আলম ~ ৩/৫ দৈনন্দিন জীবনের চাহিদায় প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। মোবাইল ছাড়া এখন তো একটা দিনও কল্পনা করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। আর এই কষ্ট থেকে রেহাই পেতেই রাশিক সাহেব কমে সেকেন্ড হ্যান্ড সেট কিনেন। অদ্ভুত ফোনকলের জন্য বদলে যেতে থাকে জীবন! সাধারণ একটা গল্প কিন্তু লেখনশৈলীর জন্য মোটামুটি ভালো লেগেছে।
২। নজরদার — কৌশিক মজুমদার ~ ২/৫ বিশৃঙ্খল একটা পরিবার একজনের জীবন নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট আবার সাথে যদি বন্ধুদল হয় নষ্টের গোড়া তাহলে তো সবই শেষ। পিচ্চি গল্পটা এমনই এক ছেলের কিন্তু কেমন জানি খাপছাড়া লেগেছে। হঠাৎ অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার শুরু আবার হঠাৎ শেষ!
৩। কিচলু ভার্সেস দ্�� ওয়ার্ল্ড — শরীফুল হাসান ~ ৩/৫ রাতের হাইওয়েতে কিচলুর গাড়ি চলছে। হঠাৎ আক্রমণ করে বসে জোম্বিরা। স্বাভাবিক পৃথিবী এখন জোম্বি ও রক্তচোষাদের! যতো অতিপ্রাকৃতিক ক্রিয়েচার নিয়ে পড়েছি তারমধ্যে জোম্বি সবচেয়ে বেশি ভয় লাগে। বিকটদর্শন চেহারা, সহজে না মরা জোম্বিদের কথা ভাবলেই ভয়ে মনটা এত্তটুকু হয়ে যায়। কিন্তু জোম্বি নিয়ে লেখা ছোট্ট গল্পটা পড়ে ভয় না বরং হাসিই আসবে বেশি।
৪। অরণ্য — তানজীম রহমান ~ ৪/৫ যুদ্ধ, অরণ্য, গভীর কালো রাত, একটি উদ্দেশ্য ও ভৌতিক কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা কয়েক পৃষ্ঠার গল্প। অরণ্যের ভিতরে ভৌতিক ঘটনা ও প্রকৃতির বর্ণনা দারুণ হয়েছে। বারবার মনে হচ্ছিল এর শেষ কোথায়!
৫। চাঁদের গায়ে ছায়া — মাহরীন ফেরদৌস ~ ২/৫ বহু আগের এক গ্রামের কথা যখন অজানা বিপদের আগমনের অপেক্ষায় আছে সবাই। শুরুটা যেভাবে হয়েছিল... শেষটা ভালো লাগলো না।
৬। কূলযক্ষ — নিলয় নন্দী~ ২/৫ অপশক্তিকে বন্দী করা হয়েছিল কিন্তু ছাড়া পেয়ে গেছে। আবার বন্দীর পথ খুঁজতে হবে এনিয়েই কাহিনী। সাদামাটা একটা গল্প।
৭। রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত — সালমান হক ~ ৪/৫ ঈর্ষা ভয়ংকর এক অনুভূতি সাথে যদি প্রতিশোধও যুক্ত হয়ে যায় তখন হয়ে ওঠে মারাত্মক ভয়াবহ। কারণ ব্যক্তির তখন বিবেক কাজ করে না, আবেগের বশবর্তী হয়ে শুধু কামনাই মনে থাকে। অন্যান্য গল্পগুলোর তুলনায় পরিসরে কিছুটা বড়। মিথের সাথে রহস্যের মিশেলে অদ্ভুত প্রেমের এক গল্প। তবে সমাপ্তি ভালো লেগেছে আমার। নেসহাত-শানযাব যা করেছে এটা তাদের পাওনাই বটে।
৮। পহেলা বৈশাখ — লুৎফুল কায়সার ~ ৩/৫ পহেলা বৈশাখে মুন মজাদার খাবার রান্না করে ফাহাদের জন্য। এইদিনটা মুন-ফাহাদ খুশিমনে কাটায়। কিন্তু উন্নতির আশায় ফাহাদ ভয়ংকর এক উপায় বের করে তারপর থেকে খুশিতে যেন কালোছায়া পড়ে। সাধারণ একটা প্লট অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে। সমাপ্তিও অনুমেয় কিন্তু লেখনশৈলীর জন্য মোটামুটি ভালোই লেগেছে।
৯। চিত্রকর্ম — ইশরাক অর্ণব ~ ৪/৫ শিল্পপতি সালেহ আহমেদের মৃত্যুর পর বাসার জিনিসপত্র বিক্রি শুরু হয়। ডিলারের চোখ আশ্চর্য জীবন্ত একটা চিত্রকর্মে আঁটকে যায়। চিত্রশিল্পীর খোঁজ করতে যেয়ে বেরিয়ে আসে না-জানা কিছু তথ্য। উপস্থাপনা ও বর্ণনার জন্য বেশ ভালো লেগেছে।
১০। ডেড এন্ড — আফরিন মৌ ~ ২/৫ বার্থডে পার্টির পর বন্ধুবান্ধবদের সাথে মুভি দেখে ফেরার সময় তাজরিয়ানের মনে হয় কিছু ভুলে যাচ্ছে সে কিন্তু কী? সুন্দর একটা নীল ক্রিস্টালের লাইটার পাওয়ার পর মনে করতে পারে না কার ছিল। লাইটার জ্বালাইতে অদ্ভুত জাদুর দুনিয়ায় চলে যায় সে! জাদুর দুনিয়া, স্পেলস, বিকটদর্শন জাদুকরী জীব, মিথ সবই আছে। এককথায় ফ্যান্টাসি জনরার মধ্যে পড়ে। শুরুতে দারুণ কিছু হবে মনে হচ্ছিল কিন্তু মাঝামাঝি অংশ থেকে কাহিনী বোরিং হয়ে গেছে। শেষটা ভালো লাগেনি আরও চমকপ্রদ কিছু হতে পারতো।
১১। সাক্ষী — বাপ্পী খান ~ ৪/৫ সোনাই নামক দুর্গম আদিবাসী গ্রামে অদ্ভুত এক পুকুর আছে যেখানে পানি কুচকুচে কালো! রহস্যময় পুকুরকে ঘিরে পিচ্চি একটা গল্প। প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভৌতিক আলোচনা ও প্লট ভালো লেগেছে। এই গল্পটা আগেও পড়েছি অন্ধকার সিরিজের বইয়ে। একই গল্প দু'টো বইয়ে না দিলেই বরং ভালো হতো।
১২। ঘাসভূমি — কৌশিক জামান ~ ৪/৫ বড় বড় ঘাসের ওপর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায় অনেক সুন্দর লাগে না? একটু হাত দিয়ে ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করে না? ছোট পরিসরের গল্পটার দু'টো বিষয় বেশি ভালো লেগেছে; প্রকৃতির বর্ণনা ও শেষের টুইস্ট।
১৩। পৃথিবীর সব ধ্বনি, সব রং মুছে গেলে পর — ওয়াসি আহমেদ ~ ৫/৫ নিত্যদিনকার রঙিন জীবন হঠাৎ রংহীন, অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে একজন লেখ��ের কাছে। ডাইরি আকারে নিজের অভিজ্ঞতাগুলো বলে হঠাৎই যেন উধাও হয়ে যান! লাভক্রাফটিয়ান হরর ও মিথ নিয়ে দারুণ একটা গল্প।
১৪। বৈকালিক ভ্রমণ — অসীম পিয়াস ~ ৩/৫ হাঁটতে বেরিয়ে জিসানের পরিচয় হয় আরাফাতের সাথে। কথা বলে ফেরার পথে একজায়গায় জটলা দেখে থমকে যায়। কিন্তু যা দেখলো...! শেষে কি হতে পারে আগেই অনুমান করে ফেলেছিলাম তবে লেখনশৈলীর জন্য পড়ে মজা পেয়েছি।
১৫। মানোবট্রন — তানজিরুল ইসলাম ~ ৩/৫ মানুষের মন পড়তে পারে রিশাব। কিন্তু ক্লাসের একটা মেয়ের মন পড়তে পারছে না বলে আগ্রহী হয়ে ওঠে। হঠাৎ এটাও আবিষ্কার করে যে মৃত্যু হলে সে অতীতে জীবিত অবস্থায় আবার ফিরে যেতে পারে। শুরুতে ভৌতিক আমেজ থাকলেও শেষে যেয়ে বুঝা যাবে সায়েন্স ফিকশন। কোয়ার্কে থিওরির আলোচনা আরও কিছুটা সহজভাবে করলে ভালো হতো।
১৬। রাত দশটার ইংরেজি খবরের পরে — নাবিল মুহতাসিম ~ ৪/৫ অতীতের স্মৃতিচারণ সাথে গা ছমছমে পরিবেশ! আলমের স্মৃতিচারণ করার সময় মনে হচ্ছিল আমিও স্কুল জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে গেছি। শেষটাও চমকে দিয়েছে।
১৭। নির্মল বাবুর আয়না — জাহিদ হোসেন ~ ৫/৫ আয়নায় সামনে দাঁড়ালে মাঝেমধ্যে মনে হয় ওপর দিকে অন্য কোনো জগৎ নেই তো? শুনতে হাস্যকর লাগতে পারে কিন্তু আমার ভাবতে কেন জানি ভালো লাগে। এই গল্পটাও অনেকটা এমনই। পড়ার পর মনে হচ্ছিল আয়না যদি প্যারালাল ইউনিভার্সের দরজা হয়ে থাকে তাহলে কিন্তু মজাই হবে।
১৮। শাপমোচন কিংবা শরীর পাতন— যারিন তাসনিম প্রমি~ ২/৫ আদিবাসীদের নিজস্ব কিছু মিথ থাকে আবার কাল্টও। এমনই এক আদিবাসী গ্রামে আটকা পড়ে যায় তিন বন্ধু। পড়ার সময়ই সমাপ্তি যেনটা অনুমান করেছিলাম শেষে তেমনটাই পেয়েছি। বেহুকী ও রিচুয়াল নিয়ে আরও আলোচনা থাকলে ভালো হতো। "দ্য চোজেন ওয়ান" কীভাবে নির্ধারন করা হয় বুঝলাম না। মিনহাজের জন্য খারাপই লাগলো। যৌনতা ও গালাগালি একটু বেশিই মনে হয়েছে গল্পে।
১৯। খোয়াবনামা — আবরার আবীর ~ ৩/৫ স্বপ্নে একটা ছেলেকে বারবার দেখে নাজমি। ��্রতিটা স্বপ্নে ঘটনা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যায়। প্রথম দিকে ভালোই লেগেছে কিন্তু শেষটা আরও গোছানো হলে ভালো হতো।
২০। ঈশ্বরের প্রতিরূপ — তাওসীফ আহমেদ ~ ৪/৫ সময়টা ভবিষ্যতের পৃথিবীর যখন তীব্র শীতে বেঁচে থাকাটাও যুদ্ধের সামিল। রহস্যময় এক জীবের আগমনে এক পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হতে থাকে। এই গল্পটা বাকিগুলোর তুলনায় অন্যরকমের, ক্রিপি এলিমেন্টও যথার্থই আছে।
২১। নিশি — সিদ্দিক আহ��েদ ~ ৫/৫ আমবাগানে ঘেরা জমিদার বাড়ি, পুরোনো মন্দির ও ভাঙাচোরা পুকুর ঘাট স্নিগ্ধ সুন্দর রহস্যময় হাতছানি দেয়। নিজাম কয়েকবার কিশোর বয়সী বিধবা মেয়েকে দেখে কিন্তু হঠাৎই উধাও হয়ে যায়। রাজবাড়ী কেন্দ্রিক গল্প। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে গল্প বলার স্টাইলটা। মনে হচ্ছিল ছায়াঘেরা জমিদার বাড়ি আমিও দেখতে পারছি। শেষবারের মতো নিশি বুড়ো নবীনকে দেখা দিবে ভেবেছিলাম। এতোবছর মেয়েটাকে একবার দেখার জন্য অপেক্ষা করলো কিন্তু...।
২২। বারি হারাতা — সাঈদ শিহাব ~ ৩/৫ বিচ্ছিন্ন এক গ্রামবাসীর ওপর আর্টিকেল লিখতে এক সাংবাদিক চলে যায় পাহাড়ঘেরা এক রহস্যময় গ্রামে। তারপর শুরু হয় অদ্ভুত সব কান্ড। পার্বত্য অঞ্চলের একটা মিথের ওপর লেখা গল্পটা। শেষটা ভালো লেগেছে।
২৩। চিত্রকর ও নারী চতুষ্টয় — দীপিকা মজুমদার ~ ৪/৫ অতনু একজন জিম ট্রেনার। একদিন বাসায় আসার পথে রহস্যময় এক নারীকে দেখে। এইভাবে নির্দিষ্ট দিন পরপর এমন কয়েকজন নারীকে দেখে যাদের সে ছাড়া কেউ দেখতে পারে না। রহস্যদ্ধার করতে যেয়ে নিজেই রহস্য হয়ে যাবে না তো অতনু? প্লটটা ইন্টারেস্টিং কিন্তু "কেন তাদেরই চুজ করা হচ্ছে?" এই প্রশ্নটার স্পষ্ট ব্য��খ��যা থাকলে আরও ভালো লাগতো। সনাতন শাস্ত্রমতে নারী-পুরুষের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য জানা ছিল না। একদম শেষের প্রশ্নটার জন্য অজানা তথ্য জানতে পারলাম।
২৪। একটি পরিবর্তনের ইতিকথা — প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার ~ ৩/৫ স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে মায়ের থেকে আলাদা থাকা শুরু করে ছেলে পারিবারিক ঝামেলা সমাধান করার জন্য। কিন্তু মায়ের এই বয়সে ছোট বাচ্চা দত্তক নেওয়া দেখে প্রথমে আশ্চর্য হলেও পরে মেনে নেয়। কিন্তু ছোট মেয়েটার সংস্পর্শে স্ত্রী-কন্যা বদলে যেতে থাকে! একটি পরিবার, মানবিক সম্পর্ক, মিথ ও গুপ্তসংঘ নিয়ে লেখা। মাঝামাঝি এসে স্লো হওয়ার দরুন কিছুটা বিরক্ত লেগেছিল কিন্তু সমাপ্তি ভালো লেগেছে।
বইয়ের সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয় হলো "ভুল"; বানান ভুল, নামে ভুল, বিরামচিহ্নে ভুল ও শব্দ মিসিংও আছে। আর এই ভুলের সংখ্যা "অনেক"। আশা করি প্রকাশনী এসব ভুল নিয়ে আরও সচেতন হবে।
আমি বরাবর খুব ভীতু মানুষ। অল্পতেই কাইত যাকে বলে। ভুলে যদি কোন ভয়ের কিছু দেখে ফেলি কিংবা পড়ে ফেলি, তাহলে সারারাত আমার রুমে ইউটিউবে আয়াতুল কুরসি চলে। সেই আমি অতীন্দ্রিয় নামের একটা বিশাল সংকলন কিনে ফেলার সাহস করলাম কীভাবে সেটা আমার নিজের কাছেই একটা রহস্য। তবে বইয়ের প্রথম পাতায় ভৌতিক গল্প সংকলনের জায়গায় অতিপ্রাকৃত গল্প সংকলন লেখাটা খানিকটা সাহস যুগিয়েছে বৈকি। এর সাথে যোগ হয়েছিল সূচীতে চমৎকার কিছু লেখকের নাম। আর অবশ্যই সম্পাদনায় @salman_reads আর প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার এর নাম। সালমান হকের শুধু একটা বই-ই পড়বার সুযোগ হয়েছে সাম্প্রতিককালে। প্রান্ত ঘোষ দস্তিদারের একটাও না। অথচ উনাদের এত নাম শুনছিলাম আশেপাশে যে ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না যে কোনটা দিয়ে শুরু করা উচিত। এরপর যখন অতীন্দ্রিয় প্রকাশিত হল, তখন মনে হল এটাই মোক্ষম সুযোগ।
অতীন্দ্রিয়-তে ২৪টি মৌলিক গল্প আছে। এবং আগেই বলেছি যে অতীন্দ্রিয় অতিপ্রাকৃত গল্পের সংকলন। তাই এতে স্থান পাওয়া গল্পগ��লো কেবল ভৌতিক নয়, বরং যা কিছু সাধারণ চোখে অস্বাভাবিক ঠেকে, ঠিক তাই। এতে যেমন আমাদের আটপৌরে বাঙ্গালি ভয়ের গল্প আছে, তেমনি গুপ্তসঙ্ঘের গায়ে কাঁটা দেয়া তন্ত্র-মন্ত্রের কারবার আছে, আবার আছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর আদলে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাহিনী। আর সেই সাথে সাইকোলজিক্যাল আর গথিক হরর তো আছেই।
২৪টা গল্পের মাঝে ধরে ধরে সবগুলোর ব্যাপারে কথা বলা যেমন মুশকিল, তেমনি একটা বা দু’টো নিয়ে কথা বলা-ও প্রায় অসম্ভব। কিছু প্রিয় লেখকের লেখা যেমন বইমেলায় তাঁদের নতুন বই না পাবার আক্ষেপ চাগিয়ে তুলেছে, তেমনি প্রথমবার পড়া কিছু লেখকের লেখা পড়বার পর আমি তাঁদের আর কী বই আছে তার খোঁজ করতে বসে গেছি। আবার কিছু সাম্প্রতিক পরিচিত লেখকের লেখা পড়ে মনে হয়েছে যেন পুরনো বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। আর সংকলনে দুই বাংলার লেখকদের মেলবন্ধনের ব্যাপারটি বেশ ভালো লেগেছে।
আপনি যদি কোন লেখকের উপন্যাস কিনে পড়বার আগে একটু পরখ করে দেখতে চান, তাহলে সংকলনের বিকল্প নেই। আর সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে অতীন্দ্রিয় সংগ্রহে রাখবার মত একটা বই। পড়ে দেখতে পারেন। সময় মন্দ কাটবে না। সম্পাদকদ্বয়ের জন্যে আমার অনেক শুভকামনা।
Believe nothing you hear, and only one half you see. - Edgar Allan Poe - অতীন্দ্রিয় - "অতীন্দ্রিয়" বইটি মূলত একটি অতিপ্রাকৃত ধারার গল্প সংকলন। ২৪ জন লেখকের ছোট-বড় ২৪টি গল্প নিয়ে এই গল্পসংকলনটি ২০২১ সালে "আফসার ব্রাদার্স" থেকে প্রকাশিত হয়। - তোমার গোপন কথাটি - জুবায়ের আলম: "অতীন্দ্রিয়" গল্প সংকলনের প্রথম গল্প। রাশিক নামের এক অফিস ক্লার্কের একটি পুরোনো মোবাইল ফোন কেনা নিয়ে এই গল্পটি শুরু এবং তার পরবর্তী ঘটনা নিয়েই গল্পটি এগিয়েছে। এই গল্পের লেখকের লেখনশৈলী বরাবরই আমার ভালো লাগে, এই ছোটগল্পেও এই ব্যপারে আশাহত হতে হয়নি। তবে গল্পের মুল কাহিনি খুবই টিপিক্যাল লাগলো, কয়েক প্যারা পড়ার পরেই এর গতি-প্রকৃতি বোঝা যায়, শেষটাও গতানুগতিক ধাঁচের। - নজরদার - কৌশিক মজুমদার: এক কিশোরের ছেলেবেলা এবং সে সময় থেকেই তার উপর ছায়ার মতো লেগে থাকা এক লোককে নিয়ে কাহিনি। এই গল্পে পশ্চিমবঙ্গের টোন স্পস্ট এবং ��েখনশৈলীও খুব একটা টানলো না, তবে শেষ প্যারাটা বেশ চমকপ্রদ ছিলো। - কিচলু ভার্সেস দ্য ওয়ার্ল্ড - শরীফুল হাসান: কিচলু নামের এক লোক তার এক বিশেষ কাজে ড্রাইভারসহ ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে দেখতে পায় অদ্ভুত ধরনের কিছু মানুষদের। জোম্বি সম্পর্কে ধারণা থাকায় তার বুঝতে দেরি হয় না যে তারা জোম্বির পাল্লায় পড়েছেন। তার পরে কিচলু সাহেব তার সাথের ড্রাইভারটিকে নিয়ে কী ব্যবস্থা নেন তা নিয়েই গল্পের পরবর্তী অংশ। ছোট গল্প হলেও বাংলা ভাষায় এমনভাবে জোম্বির কনসেপ্ট আনার ব্যপারটা এই গল্পে দারুন লাগলো। গল্পের কাহিনির সাথে সাথে জোম্বি ১০১ কোর্সও করা হয়ে যাবে পাঠকদের। গল্পের লেখনশৈলী এবং হিউমারের প্রয়োগ বেশ ভালো হওয়ায় বলা যায় গল্পটি ভালোই উপভোগ করতে পেরেছি। - অরণ্য - তানজীম রহমান: এই গল্পে দেখা যায় এক রাজা তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছায় যেখানে তাদের সোজা এক ঘন জঙ্গলের ভেতরে দিয়ে যেতে হবে। জায়গাটা খুব একটা নিরাপদ না হওয়ায় সেই রাজা তার দুই সহচরকে পাঠায় জঙ্গলের শেষে এক প্রভাবশালী লোকের কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য। খুবই এক্সপেরিমেন্টাল ধাঁচের এই গল্পটা পড়ার সময় বেশ আর্থারিয়ান লিজেন্ড টাইপ ফ্যান্টাসির ভাইব পেলাম। লেখকের ভাষাশৈলী বেশ অনন্য ছিলো এই গল্পে। তাছাড়া পুরো গল্প জুড়ে রবার্ট ফ্রস্টের Stopping by Woods on a Snowy Evening কবিতাটির হোমেজের ছাপ স্পষ্ট, কবিতাটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে গল্পটি ভালো লাগার পরিমাণ বাড়তে পারে। - চাঁদের গায়ে জোছনা - মাহরীন ফেরদৌস: অনেক অনেক বছর আগে এক গ্রামে "আ" নামের এক বালক জন্ম নেয়। তার জন্মের বেশ কিছুদিন পরে গ্রামের শিশু এবং বৃদ্ধদের মাঝে ছড়িয়ে পরে এক মহামারী। কিভাবে গ্রামবাসী এই মহামারী থামানোর চেষ্টা করে তা নিয়েই এই গল্প। এই গল��পের প্লট বা লেখনশৈলী কোনটাই তেমন একটা টানলো না। - কূলযক্ষ - নিলয় নন্দী: বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইমাম হোসেন নামক এক লোককে হঠাৎ বিপিন নামের একজন তাদের বাসায় এনে এক অদ্ভুত আবদার করে এবং সেই আবদারের পরিপ্রেক্ষিত নিয়েই এই গল্প। গল্পের প্লট টিপিক্যাল হাউন্টেজ হাউজ হরর হলেও এর লেখনশৈলী এবং ভয়ের পরিবেশ তৈরি করার ব্যপারটা দারুণ লাগলো, বিশেষ করে গল্পের শুরু এবং কূলযক্ষের কনসেপ্টটি। যেভ��বে গুছিয়ে গল্পটি লেখা হয়েছিল সে হিসেবে ফিনিশিংটা একটু তাড়াতাড়িই হয়ে গেল মনে হয়েছে। সবমিলিয়ে অবশ্য ভালোই লাগলো গল্পটা। - রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত - সালমান হক: ভার্সিটি পাশের পরে মোটামুটি বেকার অবস্থায় বসে আছে রক্তিম নামের এক যুবক। সে সময়ে রকি নামের এক পরিচিত প্রকাশকের কাছ থেকে এক কাজের অফার আসে তার কাছে, এর ফলে সে,দায়িত্ব পায় একটি বাস্তব ঘটনার অতিপ্রাকৃতিক সংকলনে কাজ করার। সেই সংকলনে কাজ করতে গিয়ে সে পড়তে শুরু করে এক অদ্ভুত আখ্যান। সেই অদ্ভুতুড়ে গল্পকে নিয়েই গল্পটির পরবর্তী অংশ। নেস্টেড/ফ্রেম স্টোরি বা গল্পের ভেতরে গল্প স্টাইলে লেখা হয়েছে এই কাহিনিটি। এই গল্পের প্রতিটি নতুন ধাপে যাওয়ার পরে কাহিনির থিম চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছিলো, যা বেশ ভালো লাগলো। ওভারঅল চমৎকার অতিপ্রাকৃতিক গল্প, লেখকের অনুবাদের পাশাপাশি মৌলিক লেখাতেও কিছুটা সময় দেয়া উচিত এখন বলে মনে হয়। - পহেলা বৈশাখ - লুৎফুল কায়সার: ফাহাদ এবং মুন দম্পতি, আপাতদৃষ্টিতে বেশ সুখী এক কাপল। কিন্ত ফাহাদের অফিসের সবার প্রমোশন হলেও তার প্রমোশন হচ্ছিলো না, তাই তিনি প্রমোশনের জন্য ধরেন ভয়াবহ এক পন্থা। মোটামুটি লাগলো গল্পটা, লেখকের এবারের বইমেলায় প্রকাশিত মৌলিকেও একই নামের এক দম্পতি রয়েছে, দুটো দম্পতিই একই নাকি সে ব্যপারে ভালোভাবে বোঝা গেল না। - চিত্রকর্ম - ইশরাক অর্ণব: সালেহ আহমেদ নামের শহরের এক শিল্পপতি মারা গেলে তার বাসায় এসে হাজির হন এক আর্ট কালেক্টর। কিন্তু সেখানে আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মানের এক পেইন্টিং এ চোখ আটকে যায় তার। সেই চিত্রকর্ম নিয়ে খোঁজ খবর করা শুরু করলে সে জানতে পারে অভাবনীয় কিছু তথ্য। নবীন লেখক হিসেবে এ ধরনের গল্পের প্লট বাছাই করাটা বেশ ভালো লাগলো। এছাড়াও নানা ধরনের আর্ট বিষয়ক তথ্য এবং এক ধরনের অতিপ্রাকৃতিক জীবের বর্ণনা বেশ ইন্টারেস্টিং ছিলো। তবে গল্পে কিছু শব্দের রিপিটেশন ছিলো বেশ ভালো পরিমাণে, বড় পরিসরে গল্প লেখার সময়ে লেখক ব্যপারটা মাথায় রাখবেন আশা করি। - ডেড এন্ড - আফরিন মৌ: তাজরিয়ান, তার কাছের বন্ধুদের নিয়ে আসে এক খাবারের দোকানে, সেখানে অবশ্য সে বার্থডে সারপ্রাইজ পেয়ে যায় তাদের কাছে। সেদিন রাতে বাসায় আসার পরে তার অবশ্য মনে হয় কিছু একটা ব্যপারে সে ভুলে যাচ্ছে। এদিকে সে তার ব্যাগে একটা লাইটার পেয়ে যায়। এক রাত্রে সেই লাইটার জ্বালালে সে অদ্ভুত এক জগতে প্রবেশ করে এবং তার পরবর্তী ঘটনা নিয়ে এই গল্পের কাহিনি। "ডেড এন্ড" গল্পটা সংকলনের সবথেকে বড় গল্প, যদিও হরর বা সুপারন্যাচারাল স্টোরির চেয়ে গল্পটাকে আরবান ফ্যান্টাসি হিসেবেই বেশি ভালো লাগলো। গল্পের প্লট বেশ বিশাল, তাই সবথেকে বড় গল্প হবার পরেও মনে হলো কোন কোন বিষয়ে আরো বর্ণনা করা যেত। গল্পে ম্যাজিক স্পেল থেকে শুরু করে অতিপ্রাকৃতিক প্রাণীর ব্যবহার করার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। যদিও নবীন লেখক হিসেবে চরিত্রের নামকরণ এবং লেখনশৈলীতে দুর্বলতার ব্যপারটা লক্ষনীয় ছিলো। সামনে লেখকের কাছ থেকে আরো বড় পরিসরে এবং আরো উন্নতমানের লেখনশৈলীর গল্প পাওয়ার আশা করছি। - সাক্ষী - বাপ্পী খান: এক পত্রিকার নতুন এক ইন্টার্ণের তার সহকর্মীকে নিজের দেখা এক ঘটনা বলা নিয়ে এই কাহিনি। সে তার দুই বন্ধুসহ গারো পাহাড়ে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়লে সোনাই নামে এক গ্রাম্য পল্লীতে আশ্রয় নেয়। তারা সেখানেই সে জানতে পারে অদ্ভুত এক অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা। এই গল্পের শুরুটা মোটামুটিভাবে হলেও আসল কাহিনিতে আসার পরে খুবই ইন্টারেস্টিং মোড় নেয়। শেষটাও বেশ দুর্দান্ত, লেখকের নিজস্ব লেখনশৈলীর ছাপ পাওয়া যাবে এতে। - ঘাসভূমি - কৌশিক জামান: এই গল্পে জানা যায় এক বিরাণ ভূমিতে এক লোক টিলার উপরে একটি কাঠের বাড়ি নির্মাণ করে থাকা শুরু করেন এবং তার পরবর্তী ঘটনা নিয়েই গল্পটি লেখা। মজার ছলে এবং ছোট পরিসরে লেখা গল্পটা বেশ গতানুগতিকই লাগলো। তবে গল্পের শেষ প্যারাটা একেবারেই আনএক্সপেক্টেড ছিলো। - পৃথিবীর সব ধ্বনি, সব রঙ মুছে গেলে পর - ওয়াসি আহমেদ: এই গল্পের মূল পটভূমি এক লেখকের ডায়রি।আনরিলায়েবল ন্যারেটরের মাধ্যমে এই গল্পের কাহিনি এগিয়েছে। একটু উইয়ার্ড ধারার এই গল্পটা বেশ ভালোই লাগলো হরর ফিকশন হিসেবে, প্রথমদিকে "রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত" টাইপের ডায়রি ভিত্তিক গল্প মনে হলেও যতই গল্প এগিয়েছে কাহিনির ভয়াবহতার লেভেল ততই বেড়েছে। গল্পে কয়েকজন লেখকের এস্টার এগ আর নামকরণও কাহিনি অনুসারে চমৎকার লাগলো। - বৈকালিক ভ্রমণ - অসীম পিয়াস: জিসান নামের এক কিশোর এক অঞ্চলে নতুন আসে। সেখানেই তার সাথে আরাফাত নামের আরেক কিশোরের দেখা হয়। কথায় কথায় আরাফাত নামের কিশোরটি বলতে থাকে তার জীবনের অদ্ভুত এক ঘটনা। এই গল্পটা একেবারে প্রথম থেকেই প্রেডিক্টেবল এবং শেষে গিয়ে তেমন একটা সারপ্রাইজ করতে পারলো না, আমি ধরেই নিয়েছিলাম ঠিক এধরনের এন্ডিংই হবে। তাই এই গল্পটাও তেমন একটা সুবিধার মনে হলো না। - মানোবট্রন - তানজিরুল ইসলাম: রিশাব নামের এক কিশোর ছোটবেলা থেকেই মানুষের মন পড়তে পারে। কিন্তু তার এই ক্ষমতা ধাক্কা খায় যখন সে নিহা নামের এক মেয়ের সাথে পরিচিত হয়। অনেকটা সাই ফাই ঘরানার এই গল্পটা মোটামুটি লাগলো, কয়েকটা ব্যাপারের বর্ণনা আরো সহজভাবে দেয়া গেলে হয়তো আরো ভালো লাগতো। তবে গল্পটি সংকলনটির থিমের সাথে ঠিক খাপ খায়নি মনে হলো, এর বদলে গল্পটি কোন সাই ফাই সংকলনে থাকলে মনে হয় বেশি খাপ খেত। - রাত দশটার ইংরেজি খবরের পরে - নাবিল মুহতাসিম: রংপুরে থাকা রুপু নামে এক কিশোর, আলম নামে তার পরিচিত এক ভাইয়ের রংপুরে আসার খবর পায় অনেকদিন পরে। সেই ভাই রংপুরে আসলে রুপু তাকে নিয়ে শুরু করে এলাকা ভ্রমণ। এই এলাকা ভ্রমণকালে রুপুকে আলম ভাই জানায় ভয়াবহ কিছু তথ্য। খুবই ছোট গল্প হলেও এই গল্পের লেখনশৈলী যেমন নস্টালজিক করে দেয় তেমনি গল্পের ভয়ের পার্টটাও গা শিউরে ওঠার অনুভূতি এনে দেয়। হরর ফিকশন হিসেবে আমার খুবই ভালো লাগলো এই গল্পটি, এই টাইপের সংকলনের জন্য একেবারে পারফেক্ট গল্প। - নির্মল বাবুর আয়না - জাহিদ হোসেন: আজম স্যার ছাত্রদের মাঝে খুবই জনপ্রিয় এক শিক্ষক। তার শেষদিনের ক্লাসে তিনি ছাত্রদের শোনায় এক অদ্ভুত গল্প আর সবাইকে এক বিশেষ উপহার দেয় এবং তা নিয়েই গল্পের পরবর্তী অংশ রচিত। এই গল্পের লেখকের ভাষাশৈলী আমার সবসময়েই টানে, এই গল্পতেও লেখনশৈলী এবং হিউমার খারাপ লাগেনি। তবে লেখকের আগে পড়া ছোটগল্পগুলো যত ভালো লেগেছিলো এবারের গল্পটা তেমন জমলো না। লেখক দুর্দান্ত ছোটগল্প লিখেন, এজন্যই হয়তো এক্সপেকটেশন বেশিই ছিলো এই গল্পে। - শাপমোচন কিংবা শরীর পাতন - যারিন তাসনিম প্রমি: এক অজপাঁড়াগায়ে তিন বন্ধুর আসা এবং তার পরবর্তী ঘটনা নিয়ে লেখা। ফোক হরর ধাঁচের এই গল্পটি বারবার আমাকে The Wicker Man আর Midsommar নামের দুইটি প্রিয় ফোক বা কাল্ট হরর মুভি দুইটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো। গল্পটি কীভাবে শেষ হবে তা মোটামুটিভাবে আগেই বোঝা গেলেও হিসেবে গ্রাম্য প্রথা, কাল্টের বিবরণ, গ্রাম্য এলাকার বর্ণনা ইত্যাদি খারাপ লাগেনি। নবাগত লেখক হিসেবে বেশ ভালো প্রচেষ্টা ছিলো এ গল্পে বলা যায়। - খোয়াবনামা - আবরার আবীর: এক গর্ভবতী মা হঠাৎ এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা শুরু করে। এক এক এপিসোডের মতো স্বপ্নটাও ধীরে ধীরে আগাতে থাকে। এই গল্পের প্লটটা শুরুতে ইন্টারেস্টিং লাগলেও শেষটা তেমন পছন্দ হলো না,গল্পটা আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যাসহ শেষ করা গেলে হয়তো ভালো লাগতো। - ঈশ্বরের প্রতিরূপ - তাওসীফ আহমেদ: এই গল্পের পটভূমি ভবিষ্যতের ঢাকা, যেখানে তুষারপাত হচ্ছে। ভয়াবহ ���েই তুষারপাতের ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত। সেইরকমের বিপর্যস্ত এক পরিবারের কাছে এক অপরিচিত লোক বিশাল সাইজের একটি গরু দিয়ে আসে এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কাহিনিটি লেখা। এই গল্পের প্লটটিকে পুরো সংকলনের ভেতর সবথেকে উইনিক আর রিফ্রেশিং লাগলো। ডিস্টোপিয়ান ফিকশনের সাথে সুপারন্যাচারাল এলিমেন্টের ��ারফেক্ট ব্লেন্ডিং এই গল্পের প্লটকে সংকলনের বাকি গল্পগুলোকে আলাদা করেছে। বেশ তৃপ্তি পেলাম গল্পটা পড়ে। - নিশি - সিদ্দিক আহমেদ: বাংলার জমিদার আমলে নিজাম নামে এক জমিদার তাদের কেনা এক মহালের খোঁজ খবর নিতে আসে। কিন্তু সেখানে তিনি একটি মেয়েকে দেখতে পায় যাকে আর কেউ দেখতে পায় না, তাই সেই রহস্য উদঘাটনে নামেন নিজাম নামের সে জমিদার। এই গল্পের ভাষাশৈলী এবং রহস্যের বুনট বেশ ভালো, তবে রাজবাড়ির ভূত টাইপের গল্প একসময়ে অনেক পড়ায় মূল প্লটটি তেমন একটা টানলোনা আমাকে। যাদের অবশ্য এ ধরনের প্রাচীন রাজবাড়ি টাইপ ভৌতিক গল্প পড়তে পছন্দ তাদের গল্পটা আরো ভালো লাগতে পারে। - বারি হারাতা - সাঈদ শিহাব: মঈনুল হোসেন নামের এক দৈনিক ভোরের আলোর সাংবাদিক তার বন্ধুকে নিয়ে দেশের জনবিচ্ছিন্ন এক সম্প্রদায়ের খোঁজ নিতে বের হয়। সে জনগোষ্ঠীতে পৌছাঁলে তারা জানতে পারে এক অদ্ভুত কিংবদন্তির কথা। এর পরে তাদের সাথে কী ঘটে তা নিয়ে এই গল্পটি লেখা। এই গল্পটি প্রথমদিকে সংকলনের "সাক্ষী" আর "শাপমোচন কিংবা শরীর পাতন" গল্প দুইটির ভাইব দিচ্ছিলো। তবে এখানেও পাহাড়ি সম্প্রদায়টির বর্ণনা এবং অতিপ্রাকৃতিক সত্তাটির বর্ণনা খারাপ লাগেনি, মোটামুটিভাবে উতরে গেছে সুপারন্যাচারাল স্টোরি হিসেবে গল্পটি। - চিত্রকর ও নারী চতুষ্টয় - দীপিকা মজুমদার: অতনু নামের এক জিম ইন্সট্রাক্টর ঠিক পনের দিন পর পরে বিশেষ কিছু চিহ্নযুক্ত নারী দেখতে পেতে থাকে। কিন্তু তার আশপাশে থাকা কেউই সেই নারীদের দেখতে পায় না। তাই এই রহস্যের সমাধান করতে নামে অতনু। এই গল্পের প্লটটা ইন্টারেস্টিং লাগলেও খুবই গতানুগতিক এক এন্ডিং দিয়ে শেষ করা হলো গল্পটা, এক জায়গায় পুরাণের রেফারেন্স টানলেও সেটাকে আরো রহস্যময় ভাবে ব্যবহার করা যেত বলে মনে হয়েছে। - একটি পরিবর্তনের ইতিকথা - প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার: স্ত্রী সুমাত্রি আর মেয়ে মিলিকে নিয়ে এক ব্যক্তির সংসার। সেই সংসারে ব্যক্তিটির মা তার পালক কন্যা রীতি কে নিয়ে আসে তাকে কয়েকদিন রাখার জন্য। এ ঘটনার কয়েকদিন পরে সে লক্ষ্য করে তার স্ত্রী এবং মেয়ের আচরণে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের খোঁজে নেমে সে জানতে পারে বিস্ময়কর এক তথ্য। "অতীন্দ্রিয়" সংকলনের কয়েকটি গল্প প্লট কিংবা লেখনশৈলীর দিক থেকে এই গল্পের থেকে আমার দৃষ্টিতে এগিয়ে থাকলেও চরিত্রায়ণের দিক থেকে এই গল্প সম্ভবত সবথেকে এগিয়ে থাকবে। এই গল্পের পরিবারটিকে দারুণভাবে লেখা হয়েছে এবং তার সাথে সুপারন্যাচারালের সংযোগ ঘটানোও বেশ ভালোই লাগলো। সংকলনের শেষ গল্প হলেও অন্যতম সেরা গল্পও ছিলো এটি। - "অতীন্দ্রিয়" সংকলনের কারিগরি দিক থেকে দেখলে বইটি বাহ্যিক দিক থেকে খুবই প্রিমিয়াম ফিল দেয়। বইয়ের প্রচ্ছদ এবং নামলিপি এই টাইপের সংকলনের জন্য একেবারে সঠিক। হরর বা অতিপ্রাকৃত জনরার এতগুলো মানসম্পন্ন মৌলিক লেখা বাছাই করার জন্য সম্পাদকদের সাধুবাদ, গল্প সংকলনে বেশ ভ্যারিয়েশনের কাজ যে দেখানো হয়েছে তা আসলেই প্রসংশাযোগ্য। তবে বানান ভুল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে চরিত্রের নাম অদল-বদল হওয়াতে এক্ষেত্রে সম্পাদনায় কিছুটা খামতি রয়ে গিয়েছে মনে হয়। এছাড়াও কিছু ছোটখাটো টাইপিং এবং সূচিপত্রে গল্পের নাম ও লেখকের নামে একটি দৃষ্টিকটু ভুল দেখলাম। আশা করি সামনের সংস্করণে বইয়ের সম্পাদকমণ্ডলী এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এই ভুলগুলো শুধরে নিবে। - এক কথায়, বাংলা ভাষায় শুধুমাত্র অতিপ্রাকৃত জনরার উপর ভিত্তি করে বেশ ভালোমানের মৌলিক গল্পসংকলন হচ্ছে "অতীন্দ্রিয়"। যতদূর জানি এর পরবর্তী পার্টও আসবে সামনে, আমার শুভকামনা রইলো সেই সংকলনের জন্য। আশা করছি এর পরবর্তী পার্টে আরো ভালোমানের কিছু গল্প পড়তে পারবো। যারা বাংলা মৌলিক হরর কিংবা অতিপ্রাকৃত পড়তে চান তাদের জন্য এই সংকলন মাস্ট রিড।
অনেক দিন পর এত ভালো একটা অতিপ্রাকৃত গল্পসংকলন পড়লাম। ২-১টা গল্প বাদে সবগুলো গল্প অনেক ভালো লেগেছে। বইটি ধীরে ধীরে পড়েছি যার জন্য আরও মজা পেয়েছি। তবে, যতটা সময় পড়েছি, বই সাথে চিপকে ছিলাম একেবারে 😁 প্রচ্ছদটি একেবারে আগুন, খুবই ভাল লেগেছে। বইটি ধরে এক ধরনের প্রিমিয়াম ফিল পেয়েছি। বইটির দ্বিতীয় পার্ট ,"অলৌকিক" আসবে মনে হয় এ বছরেই। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, প্রি-অর্ডার শুরু হলেই কিনে ফেলব।
আফসার ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত অতীন্দ্রিয় বইটিতে ২৪জন লেখকের ২৪টা অতিপ্রাকৃত কিংবা ভৌতিক গল্প আছে। কিছু কিছু গল্প ছোটোখাটো একটা উপন্যাসও বলা যায়। আমার কাছে প্রত্যেকটা গল্পই ভালো লেগেছে, একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপভোগ করেছি। তাছাড়া প্রচলিত ধারণায় আমরা অতিপ্রাকৃত বা ভৌতিক বলতে যা বুঝি তার ��ারেকাছেও যায়নি গল্প গুলো। বরং ভিন্ন আঙ্গিকে অতিপ্রাকৃত ঘটনা উপস্থাপন করা হয়েছে। যদি অতিপ্রাকৃত গল্প পছন্দ করেন তবে এটা একটা বেস্ট বই হবে আপনাদের জন্য।
আফসার ব্রাদার্স এর বইয়ের প্রোডাকশন আর প্রচ্ছদ দুটোই ভালো হয়েছে, প্রকাশনার যেকটা বই পড়েছি আর কিছু দিন আগেও কিছু বই নিয়েছি সবগুলো বইয়ের প্রোডাকশন দারুণ হয়েছে।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ বই: অতীন্দ্রিয় সম্পাদনা: প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার, সালমান হক বিষয়: অতিপ্রাকৃত গল্প সংকলন প্রকাশনী: আফসার ব্রাদার্স প্রচ্ছদঃ আবরার আবীর প্রকাশকালঃ ২০২১ পৃষ্ঠা: ৩৮৪ মুদ্রিত মূল্য: ৫৫০ টাকা গল্পতালিকা: ১. তোমার গোপন কথাটি - জুবায়ের আলম ২. নজরদার - কৌশিক মজুমদার ৩. কিচলু ভার্সেস দ্য ওয়ার্ল্ড - শরীফুল হাসান ৪. অরণ্য - তানজীম রহমান ৫. চাঁদের গায়ে ছায়া - মাহরীন ফেরদৌস ৬. কূলযক্ষ - নিলয় নন্দী ৭. রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত - সালমান হক ৮. পহেলা বৈশাখ - লুৎফুল কায়সার ৯. চিত্রকর্ম - ইশরাক অর্ণব ১০. ডেড এন্ড - আফরিন মৌ ১১. সাক্ষী - বাপ্পী খান ১২. ঘাসভূমি - কৌশিক জামান ১৩. পৃথিবীর সব ধ্বনি, সব রঙ মুছে গেলে পর - ওয়াসি আহমেদ ১৪. বৈকালিক ভ্রমণ - অসীম পিয়াস ১৫. মানোবট্রন - তানজিরুল ইসলাম ১৬. রাত দশটার ইংরেজি খবরের পরে - নাবিল মুহতাসিম ১৭. নির্মল বাবুর আয়না - জাহিদ হোসেন ১৮. শাপমোচন কিংবা শরীর পাতন - যারিন তাসনিম প্রমি ১৯. খোয়াবনামা - আবরার আবীর ২০. ঈশ্বরের প্রতিরূপ - তাওসীফ আহমেদ ২১. নিশি - সিদ্দিক আহমেদ ২২. বারি হারাতা - সাঈদ শিহাব ২৩. চিত্রকর ও নারী চতুষ্টয় - দীপিকা মজুমদার ২৪. একটি পরিবর্তনের ইতিকথা - প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার গভীর বা সন্ধ্যা রাতে ঝড় বৃষ্টির সময় কিংবা শীতের রাতে বা তপ্ত দুপুরে অতিপ্রাকৃত গল্প পড়তে আমার ভালোই লাগে। ধীরে ধীরে সময় নিতে এই সংকলটা শেষ করছি। কিছু গল্প আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে বাস্তব জীবনেও এমন হতে পারে কি! গ্রামের পটভূমির কিছু গল্প আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ২০২০ এর যান্ত্রিক জীবনের থেকে অনেক আগের সময়ে। আবার কিছু গল্প আমাদের মনে ভূত বা অতিপ্রাকৃত কিছু আছে নাকি তা নিয়ে অন্তর দ্বন্দের সৃষ্টি করতে পারে। বেশির ভাগ গল্পই দারুন লেগেছে।এই পর্যন্ত এ ধরনের যে সব সংকলন পড়েছি তার মধ্যে অন্যতম এই বইটি। অতিপ্রাকৃত গল্প যারা পছন্দ করেন তাদের জন্য অবশ্যই পাঠ্য এই বই।ইচ্ছা করেই কোন গল্পগুলো ভালো লেগেছে বললাম না,বলে দিলে ওই নির্দিষ্ট গল্পগুলোর প্রতিই মন বেশি টানে। আমার কাছে বেস্ট লেগেছে "একটি পরিবর্তনের ইতিকথা - প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার" আশা করি সবাই পড়বেন এই বইটা। ধন্যবাদ সম্পাদকমহাদয়কে।
শেষ দু বলে দুটা ছক্কা মেরে 'অতীন্দ্রিয়' ম্যাচটা টাই করলো। টাই মানে ১ থেকে ৫ এর মাঝে ঠিক ৩ দিলাম। কৃতিত্ব শেষ দুই ব্যাটার দীপিকা মজুমদার আর প্রান্ত ঘোষ দস্তিদারের। এছাড়া সেকেন্ড ডাউন তানজীম রহমান তাঁর 'অরণ্য' দিয়ে একটা জোরদার সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। নইলে অনেক আগেই বইটা বাতিলের খাতায় ফেলে দিচ্ছিলাম। কেনো দিচ্ছিলাম সেটা পরে বলব। আগে ভালো ভালো কথাগুলি বলি।
জিমটিম করা সুদর্শন এক যুবক। বর্ষণমুখর এক রাতে সিগনালে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ হয় এক ভদ্রমহিলার সাথে, পাশে দাঁড়ানো সিএনজির যাত্রী। কেমন যেন অস্বাভাবিক সেই সাক্ষাৎ। এরপর ঠিক একইভাবে আরেকজন। অতঃপর আরো দুইজন। পনেরো দিন ব্যবধান রেখে মোট চারজন ভদ্রমহিলা দর্শন দেন যুবককে। কোনো এক অজানা কারণে চারজনই বাজেভাবে ইনজুরড। এবং সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো যুবক ছাড়া আর কেউই তাদের দেখেনা।
কাহিনী শেষে এসে বেশ কড়া একটা ধাক্কা দেয়। চমৎকার একটি কনসেপ্ট। আগে কোথাও পড়া হয়নি। 'চিত্রকর ও নারী চতুষ্টয়' - লিখেছেন দীপিকা মজুমদার।
সংকলনের সম্পাদক প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার ওস্তাদের মারটা শেষ রাতেই দিয়েছেন, মানে একদম সংকলনের শেষে। অতি প্রাচীন এক কাল্ট, তাদের অদ্ভুত এক দেবতা, দেবতাকে ঘিরে চলা কিংবদন্তি, আর সেই দেবতার উপাসনার সাথে কিভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলো বর্তমান শহুরে জীবনের এক সাংসারিক মানুষ ও তাঁর পরিবার - তারই উপাখ্যান 'একটি পরিবর্তনের ইতিকথা'।
প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার তাড়াহুড়ো করেননি একদমই। ধীরে ধীরে ঘটনার জাল বুনেছেন। যেটা অন্য লেখকদের লেখায় ছিলোনা। আবার কাহিনীতে কোনো অসংলগ্নতা দেখিনি, যেটা বাকি লেখকদের লেখায় ছিলো একদম কমন। মোটের ওপর পাকাহাতের লেখা।
তবে পুরো ইনিংসে সবচেয়ে দুর্দান্ত খেলেছেন তানজীম রহমান। তাঁর লেখা 'অরণ্য' আসলেই অতীন্দ্রিয়, অপার্থিব একটি লেখা। মধ্যযুগের এক সৈনিক, যে তার মৃত সতীর্থের দেহ সাথে নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে নিষিদ্ধ জঙ্গল। সঙ্গী কেবল তার পোষা ঘোড়া। ভয়াবহ তুষারাচ্ছন্ন সেই বিকেলে অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় সৈনিক। অনাকাঙ্ক্ষিত, ব্যাখাতীত। তানজীম রহমান সেই ব্যাখাতীত ঘটনাগুলো একের পর এক সাজিয়েছেন, সাথে তৈরী করেছেন লোমহর্ষক একটি পরিবেশ। অস্বাভাবিকতার জন্য 'অরণ্য' তাই সংকলনের শ্রেষ্ঠ গল্পে দাঁড়িয়ে গেছে।
এর বাইরে অনারেবল মেনশন দেয়া যায় বারি হারাতা (সাঈদ শিহাব - দুর্গম এলাকায় অবস্থিত রহস্যময় ট্রাইব ও তাদের ভয়ের উৎস অভিশপ্ত এক পাহাড়ের গল্প), তোমার গোপন কথাটি (জুবায়ের আলম - চোরাই মোবাইল কিনে জীবন ওলটপালট হয়ে যাওয়া এক মানুষের কাহিনী), রয়েছি তোমার অপেক্ষায় নেসহাত (সালমান হক - প্রাচীন মিথোলজি বেসড, কিন্তু আরো ভালো হতে পারত), বৈকালিক ভ্রমণ (অসীম পিয়াস - পুরনো কনসেপ্ট, খারাপ না), মানোবট্রন (তানজিরুল ইসলাম - এক কিশোরের কাহিনী, যে কিনা মানুষের মনের কথা টের পাওয়ার প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে), রাত দশটার ইংরেজি খবরের পরে (নাবিল মুহতাসিম - নাইন্টিজের নস্টালজিয়া, রংপুরের অলিগলি, পূর্ণিমার জ্যোৎস্না আর মানুষখেকো কিছু পিশাচ), ঈশ্বরের প্রতিরূপ (তাওসীফ আহমেদ - তুষারাচ্ছন্ন ঢাকা, অদ্ভুত এক মানুষ ও তার চাইতেও অদ্ভুত এক প্রাণীর আগমন ঘটে মধ্যবিত্ত এক পরিবারে, বর্ণনা বেশ ভালো লেগেছে) এবং চাঁদের গায়ে ছায়া (মাহরীন ফেরদৌস - চন্দ্রকলা নিয়ে লেখা এক কিংবদন্তির গল্প)।
এবার কেনো বাতিলের খাতায় ফেলতে চাচ্ছিলাম তা বলি।
সেই প্রাচীন আমলের মামদো ভূত আর শাঁকচুন্নির কমেডি ছাড়িয়ে বাংলা হরর রবিঠাকুরের ক্ষুধিত পাষাণ কিংবা বিভূতির আরক, শরদিন্দুর অশরীরী হয়ে এখন অকাল্ট হরর, সাইকোলজিক্যাল হরর এমনকি লাভক্র্যাফটেও ঢুকে বসে আছে। অতীন্দ্রিয়ও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বেশি এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে প্রায় লেখাই হয়ে গেছে রসহীন, পেঁচিয়ে গেছে ক্লাইম্যাক্স কিংবা এন্ডিং! ফলে না হয়েছে সাইকোলজিক্যাল হররের স, না হয়েছে লাভক্র্যাফটের ল।
যেমন ধরুন ওয়াসি আহমেদের 'পৃথিবীর সব ধ্বনি, সব রং মুছে গেলে পর।' লেখক খুব খেটেছেন এই লেখায়। মূলত এক হৃতগৌরব লেখকের নিজস্ব ডায়েরিতে লেখা তার প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার বর্ণনা। বড়ই অদ্ভুত সেই বর্ণনা। লেখকের জীবন স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে একে একে রং, স্বাদ, ঘ্রাণ, শব্দ। ঘর ঢেকে যাচ্ছে মাকড়শার জালে। দেয়াল মেঝে শরীর বেয়ে মাকড়ের ঝুল জায়গা করে নিচ্ছে লেখকের ভেতরটায়।
দুঃস্বপ্নকে ঘিরে লেখা এক ব্যতিক্রমধর্মী রচনা। ভালো হতে পারত। কিন্তু লেখক মাকড়শা, স্বপ্ন, ঘুম, অসুস্থতা, গ্রীক মিথলজি, এরাকনি, এথেনা সব মিলিয়ে এমন ঘুটা দিয়েছেন যে কাহিনীর আগামাথা নাই হয়ে শেষে পাগলের প্রলাপে দাঁড়িয়ে গেছে! শেষদিকে ঘুম আসতে পারে, আগাম সতর্কবার্তা।
এরপর ধরুন সাক্ষী। বাপ্পী খানের লেখা। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জঙ্গলের মাঝে হঠাৎই উদয় হওয়া এক অভিশপ্ত পুকুর। যার স্পর্শে মরা মানুষ ভ্যাম্পায়ারে রুপ নেয়। এ গল্পটিও কথকের বাচনভঙ্গি আর ক্লাইম্যাক্সের তাড়াহুড়োর কারণে শেষে এসে নিরস হয়ে গেছে!
জাহিদ হোসেনের নির্মল বাবুর আয়নাও সেম। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত নির্মলবাবুর দুঃস্বপ্ন, তার প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের ভাই থেকে প্রাপ্ত আয়না আর ওষুধ, সেই আয়না আবার ভার্সিটির আজম স্যার স্টুডেন্টদের গিফট দেন বিদায়ের দিনে - সবমিলিয়ে ভজঘট অবস্থা। মনে হলো লেখক একটা আধুনিক গল্পের পেট চিরে ভেতরে আশির দশকের একটা গল্প ঢুকিয়েছেন। কোনোটাই ঠিকমত ক্লিক করেনি।
যারিন তাসনিম প্রমির 'শাপমোচন কিংবা শরীর পাতন' বেশ ভালো একটা অকাল্ট হরর হতে পারত। স���ন্দরবন, বাওয়ালি, অজানা কোনো এক অকাল্ট, আরাধ্য দেবতা, কুহকিনী নারী, ফাঁদে পড়া তিন যুবক - মোটামুটি সবরকমের উপাদানই ছিলো গল্পে। শেষমেশ কোনো মতে উতরেছে। কিন্তু অতিরিক্ত গা ঘেঁষাঘেঁষি আর খিস্তির রগরগে বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখিকা সম্ভবত প্লটের দিকে তেমন মনোযোগ দিতে পারেননি।
নিষিদ্ধ ফ্যান্টাসির আরেক উদাহরণ কৌশিক মজুমদারের 'নজরদার'। লেখক মনে মনে যত গোপন ফ্যান্টাসি লালন করেন সব এই লেখাতে ঢেলে দিয়েছেন (সম্ভবত)। গল্পটা আরো ভালো পরিবেশে হাতে সময় নিয়ে লেখা যেত। এরকম সস্তা যৌনতা ঢোকানোর দরকার দেখলাম না।
বাকি গল্পগুলোও গড়পড়তা। রেটিং তাই ৩/৫। পড়লে পড়া যায় না পড়লেও সমস্যা নাই। ঐ 'অরণ্য' টা না পড়ার আফসোস ছাড়া আর কোনো লস হবেনা।
২০২১ সালের বইমেলায় Afsar Brothers থেকে বের হয়েছিল অতিপ্রাকৃত গল্পের সংকলন "অতীন্দ্রিয়"। আমি পড়লাম ২০২৩ এর নভেম্বর মাসে এসে। বেটার লেইট দ্যান নেভার!
গল্পের বই আমার পড়া হয়না বেশী, এর অন্যতম কারণ হলো গল্পের বই পড়ে হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৯৯ শতাংশ। একটা বইয়ের সবগুলো গল্প ভালো হয় না, হতে পারে না। শেষ কামড়ে একটা এলাচই যথেষ্ট বিরিয়ানির স্বাদ ভুলিয়ে দিতে। এই বইয়ের এক পর্যায়ে এসে ভেবেছিলাম সেই আশঙ্কা বুঝি সত্যি হতে চলেছে। যাক, শেষ পর্যন্ত ইট ওয়াজ এ ভেরি গুড রিড। অধিকাংশ গল্পই চমৎকার। তবে, তিনটা গল্প আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অসাধারণ লেগেছে। Salman Haque ভাইয়ার 'রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত', এবং যারিন তাসনিম প্রমি আপুর 'শাপমোচন কিংবা শরীর পাতন' দুটোতেই মিথ আর গল্প এমন নিখুঁতভাবে মিশেছে যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। কিন্তু সেরা গল্প, যে ধরণের গল্পের জন্য বাদবাকি বই অপঠ্য গল্প দিয়ে ভরা থাকলেও আফসোস হবে না বিন্দুমাত্র, হলো Tanzim Rahman ভাইয়ার অরণ্য। বার বার পড়ার মত। যত প্রশংসাই করা হোক, কম হয়ে যাবে। Zahid Hussain ভাইয়ার 'নির্মল বাবুর আয়না' আর তাওসীফ আহমেদের 'ঈশ্বরের প্রতিরূপ' গল্প দুটোও ছিল দারুণ।
প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার ভাই আর সালমান হক ভাইয়ের যৌথ সম্পাদনায় বের হওয়া বইটিকে যারা এখনও পড়েন নি (কেউ মনে হয় আর বাকি নেই! 😅) তাদের জন্য "হাইলি রেকমেন্ড" করে গেলাম। 👍
২৪টি গল্পের সমাহার ছিলো বইটিতে। এর মধ্যে রয়েছি তোমার অপেক্ষায়, নেসহাত; বৈকালিক ভ্রমণ, নির্মল বাবুর আয়না, চিত্রকর ও নারী চতুষ্টয় এবং একটি পরিবর্তনের ইতিকথা গল্পগুলো অপেক্ষাকৃত ভালো লেগেছে। সংকলন হিসেবে আহামরি লাগেনি, বরং এভারেজ বলা যেতে পারে।