বানিয়া
বানিয়া শব্দটি দ্বারা ভারতীয় সমুদ্র বাণিজ্যে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বোঝানো হতো, যারা নিজস্ব পোশাক-পরিধান, ধর্মীয় ও খাদ্য গ্রহণের রুচির ও তাদের ব্যবসা পরিচালনার দিক থেকে দিক থেকে পৃথক করা যেত।[১] তারা মূলত আঠারো এবং উনিশ শতকে ইউরোপীয় বণিকদের স্থানীয় প্রতিনিধি ছিল।
সংস্কৃত এবং বাংলা ‘বণিক’ শব্দের পরিবর্তিত ইংরেজি রূপ হলো 'বানিয়া'। ভারতীয় সমাজ ও দেশীয়দের মধ্যে বানিয়া বলতে তাকে বোঝানো হতো যিনি কোনো ইউরোপীয় ব্যবসায়ীর প্রতিনিধি বা এজেন্ট হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
উত্থান
[সম্পাদনা]ইউরোপীয় বণিকেরা সাধারণত ভারতবর্ষের ভাষা, রীতি-নীতি, ব্যবসা কেন্দ্র, স্থানীয় পর্যায়ে প্রচলিত পণ্যের পরিমাপ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে অবগত ছিল না। এজন্য তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি বা এজেন্ট নিয়োগ করতে হয়েছিল।
কার্যক্রম
[সম্পাদনা]এ বানিয়ারা সাধারণত দোটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তারা ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের হয়ে তারা দরাদরি, মধ্যস্থতা এবং তহবিল সংরক্ষণ করত এবং লেনদেনকৃত পণ্যমূল্যের দুই শতাংশ তাদের কমিশন হিসেবে প্রদান করা হতো। ইউরোপীয় ব্যাবসায়ীগণ জাহাজে করে এদেশে পৌঁছালে তারা তাদের অভ্যর্থনা জানাত, তাঁদের থাকা-খাওয়ার আয়োজন করা, তারা যতদিন থাকতেন ততদিনের জন্য তাঁদের ভৃত্য নিয়োগ করত, জাহাজে পণ্য উঠানো ও নামানো, তাদের নিয়ে আসা রূপা সিক্কা টাকায় রূপান্তরিত করা, তাদের হাটবাজারে নিয়ে যাওয়া এবং প্রয়োজন অনুযয়ী মূলধন যোগান দেওয়া এবং বিনোদনের জন্য বিদায় সম্বর্ধনাযর সময় বাইজি নাচের আয়োজন করার মাধ্যমে তারা ইউরোপীয় ব্যবসায়ীগণকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করত। তাদের ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে 'দোভাষ' ও চীনে 'কমপ্রাদোর' বলে অভিহিত করা হতো।
ফোর্ট উইলিয়াম এর গভর্নর এবং প্রত্যেক কাউন্সিল সদস্যদের এক বা একাধিক বানিয়া ছিল, যারা তাদের বাণিজ্য দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত ছিল। বানিয়ারা কেবল প্রতিনিধি বা এজেন্ট নয়, তারা পুঁজির যোগানদারও ছিল। ধারণা করা হয় যে, কোনো কোনো ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের মূলধনের প্রায় সম্পূর্ণটাই স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হতো, আর এ ক্ষেত্রে মূলধনের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল বানিয়ারা।
পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের লগ্নিমূল্য ও পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়, ফলে বানিয়াদের গুরুত্বও বৃদ্ধি পায়।[১] আগে যেমন উচ্চাভিলাষী ভারতীয়রা ব্রিটিশ গভর্নর এবং কাউন্সিল সদস্যদের অনুগ্রহলাভের জন্য প্রতিযোগিতা করতে থাকে এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের মধ্যে দলাদলি বিদ্যমান থাকায় অথবা নানা উপগোষ্ঠীর অস্তিত্বের কারণে বানিয়ারা ধনী হওয়ার সুযোগ লাভ করে এবং তা তারা কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।
ধনী বানিয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন: কান্তবাবু, রামদুলাল দে, নবকৃষ্ণ দেব, গোকুল ঘোষাল, জয়নারায়ণ ঘোষাল, নকু ধর, জয়কৃষ্ণ সিংহ, গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, কাশীনাথ বাবু এবং আরও অনেকে। উনিশ শতকের কলকাতা এবং বাংলায় প্রসিদ্ধ পরিবারগুলো প্রতিষ্ঠাতাগণ প্রায় সকলেই বানিয়া ছিলেন। তাঁদের সম্পদ দিয়ে কলকাতায় যেমন বহু প্রাসাদতুল্য ইমারত নির্মাণ করা হয়, তেমনি চিরস্থায়ী বন্ধবস্ত নিশ্চিত করার পর তারা তাদের নিজ নিজ গ্রামে জমিদারি এবং কোম্পানির বন্ড ক্রয় করেন। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানেও তাঁদের সে অর্থ ব্যয় করা হতো।
পতন
[সম্পাদনা]১৭৮৫ সালের পর থেকেই কলকাতায় স্থাপিত এজেন্সি হাউজগুলো রপ্তানী বাণিজ্যের বানিয়াদের প্রতিস্থাপন বরা শুরু করে। ১৭৮৫ সালের পর থেরক আমেরিকান ব্যবসায়ীরা বাংলায় আসে এবং নেপোলিয়নের যুগের যুদ্ধ চলাকালীন বাংলার রপ্তানিতে তাঁদের বিনিয়োগ দ্রুত বাড়তে থাকে।
তূলনামূলকভাবে, অনেক সস্তায় বানিয়াদের সেবা পাওয়া যাবে বলে আমেরিকান ব্যবসায়ীগণ এজেন্সি হাউজ প্রতিষ্ঠার না করে বানিয়া নিয়োগ দেয়। ১৮১৩ সালের সনদ আইন পাসের পর ভারত মুক্তবাণিজ্যের আওতায় হয়। তাই, অনেক বিদেশীও বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ করতে আসে। এর ফলে, কিছু সময়ের জন্য বানিয়া শ্রেণির সুযোগ বৃদ্ধি পেলেও ব্যাংকিং এবং অন্যান্য সেবা সুবিধা গড়ে ওঠায় বানিয়ারা তাদের গুরুত্ব হারায়, ফলে সে সুযোগ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
এগসব কারণে ১৮৫০ সাল নাগাদ বানিয়াদের পতন বা বিলুপ্তি ঘটে।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]- ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
- নেপোলিয়ন বোনাপার্ট
- আলেক্সেই ব্রুসিলভ
- ব্রিটেন
- গ্রেট ব্রিটেন সাম্রাজ্য
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ "বানিয়া – বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২২ জুন ২০২০।