গাম্বো
উৎপত্তিস্থল | যুক্তরাষ্ট্র |
---|---|
অঞ্চল বা রাজ্য | লুইজিয়ানা |
প্রধান উপকরণ | রৌউক্স, ঢেঁড়স, ফিলি গুড়ো, মাংস এবং/অথবা শেলফিস, পাথুনি শাক, ক্যাপসিক্যাম |
সাধারণত ১৫৫০ প্রতি গামলায় কিলোক্যালরি | |
গাম্বো একটি স্ট্যু জাতীয় খাবার যা ১৮ শতকে দক্ষিণ লুইজিয়ানায় উদ্ভূত হয়। প্রাথমিকভাবে এটা কড়া স্বাদের হয়। মাংস বা শেলফিস, একটি ঘনকারক এবং লুইজিয়ানিরা যাকে বলে সব্জির ট্রিনিটি সেলারি, বেল পিপার এবং পেঁয়াজ দিয়ে এটা তৈরী হয়। ব্যবহৃত থিকেনার বা ঘনকারকের উপর ভিত্তি করে গাম্বো বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। ঢেঁড়শ, চক্টো মসলা ফাইল গুঁড়া (শুকনো এবং গুড়ো করা সাসসাফ্রাস পাতা) বা রৌউক্স (ময়দা এবং চর্বি দিয়ে তৈরী ফরাসী বেস) ইত্যাদি ঘনকারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। খাবারটি এর নাম সম্ভবত বান্টু ভাষায় ঢেঁড়স (ki ngombo) বা চক্টো শব্দ জন্য ফাইল (kombo) থেকে পেয়েছে।
গাম্বোর বেশকিছু বৈচিত্র্যের অস্তিত্ব আছে। ক্রিয়োলি গাম্বোতে সাধারণত শেলফিস, টমেটো, এবং গাঢ় রৌক্স, ফাইল বা উভয়ই থাকে। কাজুন গাম্বো গাঢ় রৌক্সের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় এবং শেলফিস বা ফাউলের সাথে মিশিয়ে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন প্রকার গাম্বোতে প্রায়শই সসেজ অথবা হ্যাম যোগ করা হয়। বেস বা ভিত্তি তৈরী করার পরে সবজি রান্না করে নিয়ে মাংস যোগ করা হয়। খাদ্যটি ঘণ্টা তিনেক রান্না করা হয়, শেষের দিকে শেলফিস এবং কিছু মশলা যোগ করা হয়। ইচ্ছা করলে তাপ থেকে সরিয়ে নিয়ে কিছু ফিলি গুড়ো যোগ করা যায়। ঐতিহ্য অনুসারে গাম্বো ভাতের উপর পরিবেশন করা হয়। গাম্বো জ'হারবেস কম পরিচিত তৃতীয় একটি গাম্বো যেখানে মাংস ব্যবহার করা হয় না। সবুজ শাক ধীরে ধীরে রান্না করা হয়, রৌক্স দিয়ে গাঢ় করা হয় এবং ভাতের পাশে পরিবেশন করা হয়।
খাবারটিতে ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান, পশ্চিম আফ্রিকান, এবং চক্টোসহ বিভিন্ন সংস্কৃতির রন্ধনশৈলী এবং উপাদানের সমন্বয় ঘটেছে। পশ্চিম আফ্রিকার বা স্থানীয় খাবারের ঐতিহ্য অনুসারে অথবা ফরাসি খাবার বুইল্লাবেইসসের উপজাত হিসেবে গাম্বো তৈরী হতে পারে। ১৮০২ সালে সর্বপ্রথম গাম্বো সম্পর্কে বর্ণনা করা হয় এবং ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিভিন্ন রান্নার বইয়ে গাম্বো সংযুক্ত হয়। ১৯৭০ দশকে, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট লুইজিয়ানার সিনেটর এলেন এলেন্ডারের সম্মানে সিনেট ক্যাফেটেরিয়ার খাদ্যতালিকায় গাম্বো যুক্ত করলে এটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮০ দশকে শেফ পাউল প্রুধোমের জনপ্রিয়তা গাম্বো সম্পর্কে জনমানসের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। গাম্বো লুইজিয়ানার জাতীয় খাবার।
ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]বিশেষজ্ঞ এবং শেফগণ ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। খাদ্যটি সম্ভবত এর প্রধান দুটি উপকরণ ঢেঁড়স এবং ফিলির উপর ভিত্তি করে গাম্বো নামটি অর্জন করেছে। পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দাস নাইজার-কঙ্গো ভাষায় কথা বলতো। ঢেঁড়স কি গম্বো বা কুইনগম্বো নামে পরিচিত ছিলো। শব্দটি আমবুন্ডু ওচিংগম্বো এবং শিলুবা চিংগম্বোর অনুরূপ। স্থানীয় চক্তো ভাষার লোকেরা ফিলি বা বাটা স্যাসসাফ্রাস পাতাকে কম্বো বলে থাকে।
বৈচিত্র
[সম্পাদনা]"গাম্বো লুইজিয়ানার একটি পরিবর্তিত শিল্প। সেখানে যত জন রাঁধুনি আছেন ঠিক ততটি গাম্বো রন্ধন প্রণালী আছে।"
স্টায়ার দ্যা পটঃ দ্যা হিস্টোরি অভ কাজুন কুইজিন, পৃষ্ঠা. ১৫
গাম্বো একটি উচ্চমশলাযুক্ত স্যুপ বা ঝোল যাতে বিভিন্ন ধরনের মাংস অথবা সীফুড থাকে। যে কোন প্রকার মাংস যা সামুদ্রিক খাবার ব্যবহার করা গাম্বো তৈরিতে। মাংসপ্রধান গাম্বোতে মুরগির মাংস, হাঁস, কাঠবিড়াল, বা খরগোশ সঙ্গে ঝিনুক বা শুক্তিসমূহ মাঝে মাঝে যোগ করা হয়ে। সামুদ্রিক খাবার ভিত্তিক গাম্বোতে চিংড়ি,কাঁকড়া এবং কখনো কখনো ঝিনুক বা শুক্তি জাতীয় সী ফুড ব্যবহৃত হয়। এই খাবারে ঝাঁঝালো স্বাদ আনতে প্রায়শই এন্ডোইলে সসেজ যোগ করা হয়। সসেজ এবং হ্যামের ব্যতিক্রম হিসেবে গোমাংস এবং পোর্ক ব্যবহার হয় না বললেই চলে। অধিকাংশ গাম্বো পেঁয়াজ, পার্সলে, ক্যাপসিকাম, এবং সেলারি দিয়ে বৈচিত্র্যময় করা হয়।[১] সামুদ্রিক গাম্বোতে অনেকসময় টমেটো ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে অন্যান্য সব্জিও যোগ করা হয়।[১]
ঘনকারক
[সম্পাদনা]গাম্বো জ্যুস বা ঝোল প্রাথমিকভাবে ঢেঁড়স, ফিলি গুড়ো এবং রৌক্স দিয়ে ঘন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী রন্ধনশৈলীতে ঢেঁড়স এবং ফিলি গুলো একই সাথে ব্যবহার করা হয় না। তবে অনেক সময় প্রথা ভাঙার উদাহরণও আছে। শুধুমাত্র রৌক্স অথবা অন্য উপাদানদুটির সাথে ব্যবহার করা হয়।
মাংসের তুলনায় সামুদ্রিক গাম্বোতে ঢেঁড়স প্রায়ই ঘনকারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই আঠালো সবজিটি প্রথমে রান্না করে নেওয়া হয় এর পর ঘন হয়ে এলে অন্যান্য উপাদান যোগ করা হয়। দ্যা অক্সফোর্ড কম্প্যানিয়ন টু ফুড এর মতে ঢেঁড়সের স্বাদ তুলনামূলক ভাবে কম হওয়ায় ওকড়া (ঢেঁড়শ) গাম্বোর কদর কিছুটা কমে গেছে।
সবজি এবং মাংস অথবা সামুদ্রিক খাবার পূর্ণরূপে রান্না না হওয়া পর্যন্ত ঝোলে সাসসাফ্রাস পাতার গুঁড়ো যোগ করা হয় না। আগুন থেকে সরিয়ে নিয়ে এই ফিলি গুড়ো দেওয়া হয়। সিদ্ধ করার সময়ে ফিলি গুড়ো যোগ করলে গাম্বো অনেক শক্ত হয়ে যায়। শেষে যোগ করলে গাম্বো ঝাঁঝালো স্বাদ লাভ করে।
রৌক্স হচ্ছে জনপ্রিয় ঘনকারক যা প্রায় সমানুপাতে ময়দা এবং চর্বি একত্রে রান্না করে তৈরী করা হয়(ঐতিহ্যগতভাবে শুকরের চর্বি দিয়ে এটা তৈরী করা হতো কিন্তু ২০ শতকের মাঝামাঝি এসে মাখনের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়) রান্না সময় গাম্বোর চূড়ান্ত স্বাদ এবং সৌন্দর্য্য নির্ধারণ কর। রৌউক্স যোগ করার আগে দীর্ঘক্ষণ রান্না করলে গাম্বো গাঢ় হয়। খুব গাঢ় রোউক্স পাতলা রৌউক্সের তুলনায় অধিক কড়া স্বাদ তৈরী করে।
কাজুন বনাম ক্রেয়ল গাম্বো
[সম্পাদনা]গাম্বোকে সাদারণ ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। নিউ অর্লিন্স এবং দক্ষিণ লুইসিয়ানায় গাম্বো ক্রেয়ল নামে পরিচিত। ফরাসি এবং স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকরা এখানে বাস শুরু করে এবং তাদের উত্তরপুরুষ লুইজিয়ানার ক্রেয়ল জনগোষ্ঠী। তাদের নামেই এই খাবারটি পরিচিতি পেয়েছে। কাজুন প্রকারটি দক্ষিণ-পশ্চিম লুইজিয়ানায় পাওয়া যায় যেখানে ১৮ শতকের মধ্যভাগে আকাডিয়া (বর্তমানের কানাডিয়ান প্রদেশ কুইবেক, নোভা স্কটিয়া, অন্টারিও এবং প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপ) থেকে বহিস্কৃত ফরাসীভাষী ঔপনিবেশিকদের উত্তরপুরুষ কাজুনরা বাস করে।
গাম্বো সাধারণত এর রৌউক্সের গাঢ়তা দিয়ে শনাক্ত করা যায়। চুলার আঁচে কয়েকটি বর্ণ পরিবর্তন পর্যন্ত রান্না করা হয়। রৌক্স ওকরা অথবা ফিলি গুড়োর সাথে ব্যবহার করা হয়। পানির কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে সামুদ্রিক গাম্বো খুবই জনপ্রিয় কিন্তু দক্ষিণ পূর্ব লুইজিয়ানার জনগোষ্ঠী অধিকাংশ সময়ে মুরগী অথবা হাঁস এবং সসেজ ব্যবহার করে। সাধারনত মুরগী বা হাঁসের হাড় ছাড়িয়ে নেওয়া হয় না। কাজুন গাম্বোর উপরে পার্সলে এবং সবুজ পেয়াজ দেওয়া হয়।
ক্রেয়ল গাম্বোতে অধিকাংশ সময়ে সামুদ্রিক খাদ্য, টমেটো এবং ঘনকারক ব্যবহার করা হয়। ২০ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পূর্বে ক্রেয়ল গাম্বোতে সেলারি বা পাথুনি শাক কদাচিৎ ব্যবহৃত হতো।
গাম্বো যহারবেস
[সম্পাদনা]যখন ক্যাথলিকরা লেন্টের সময়ে মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকে তখন মাংসবিহীন এক ধরনের গাম্বো, যা গাম্বো যহারবেস নামে পরিচিত, পরিবেশন করা হয়। বিভিন্ন ধরন্র সবুজ শাকসব্জি যেমন সবুজ শাক, পালং শাক, শালগম দিয়ে রান্না করা হয়। সবুজ শাক রান্না করে মন্ড তৈরী করা হয় এবং ছাকনির সাহায্যে সবুজ তরল ছেঁকে নেওয়া হয়। এই ধরনের খাবার প্রস্তুত খুবই সময়সাপেক্ষ। লেন্টের সময়ে নিরামিষ সীমাবদ্ধতা শিথিল হলে এটা অজনপ্রিয় হয়ে পড়ে। রেঁস্তোরাতে কদাচিৎ এই খাবার পাওয়া যায়। বর্তমান সময়ে এই গাম্বোর সংগে হ্যাম অথবা কাকড়ার মাংস যোগ করা হয়।
ফরাসি, জার্মান, বা পশ্চিম আফ্রিকার রন্ধনশৈলীতে সম্ভবত গাম্বো যহারবেসের উদ্ভব হয়েছে। ফরাসি খাবার পটেজ অক্স হার্বেস (উদ্ভিদের ঝোল) এর সাথে এই খাবারের সাদৃশ্য আছে। জার্মানিতে মন্ডি থার্সডে তে খাওয়া একটি খাবারের সংগে মাংসহীন এই খাদ্যের মিল আছে। জার্মান ক্যাথলিকগণ লেন্টের নিয়ম অনুসরণ করে। এই সময়ে তারা সাত প্রকার সবুজ শাক সবজি যুক্ত ঝোল জাতীয় খাবার খেয়ে থাকে।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]প্রেক্ষাপট
[সম্পাদনা]দক্ষিণ লুইজিয়ানায় বিদ্যমান মিশ্র সংস্কৃতিকে রূপকার্থে ব্যবহার করতে গাম্বো শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে যেমন খিঁচুড়ি ব্যবহৃত হয়। খাবারটি ফরাসি, স্প্যানিশ, আদিবাসী উপজাতি, এবং আফ্রিকানসহ ইতালিয় এবং জার্মান রন্ধনশৈলীর একটি সম্মিলিত প্রয়াস। ১৮ এবং ১৯ শতকের এই অঞ্চলের অধিবাসীগণ একটি নির্দিষ্ট ছোট অঞ্চলে বাস করতো এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ছিলো। এর ফলে এক সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করার মত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো এবং নতুন ঐতিহ্য ও রন্ধনপ্রণালীর উদ্ভব হয়েছিলো।[২]
১৭১৮ সালে নিউ অর্লিন্স প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে লুইজিয়ানায় ফরাসি উপনিবেশ শুরু হয়। বেশ ঔপনিবেশিকরা বিভিন্ন স্থানীয় উপজাতি যেমন ক্টো, আলাবামা এবং চেরোকিদের সাথে মিত্রতা করে। যাদের কাছ থেকে তারা বিভিন্ন ধরনের নতুন রান্না শেখে এবং স্থানীয় ভোজ্য উদ্ভিদ সম্পর্কে জানতে পারে।
১৭১৯ সালে লুইজিয়ানায় দাসবাহী জাহাজ আসতে শুরু করে। প্রথম জাহাজে করে চাল এবং পুরুষদের আনা হয় এখানে চাষাবাদের জন্য। নতুন পরিবেশের সংগে শস্য খাপ খাইয়ে নেয় এবং কয়েক বছরের মধ্যে মিসিসিপি নদীর অববাহিকায় ধান চাষ সাধারণ হয়ে ওঠে।
১৭২১ সালে ১২৫ জন জার্মান নিউ অরলেন্স থেক ৪০ মাইল (৬৪ কিমি) দূরে বসতি স্থাপণ করে এবং সসেজ তৈরীর পদ্ধতির প্রচলণ ঘটায়[৩]। ১৭৪৬ সালে লুইজিয়ানায় ৪৭৩০ জন কালো অধিবাসীর পাশাপাশি সাদা অধিবাসীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২০০ জন। পরের ৪০ বছরে দাসদের সংখ্যা শ্বেত মানুষদের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়।.[৪][৫]
১৭৬২ সালে উপনিবেশের নিয়ন্ত্রণ ফরাসিদের কাছ থেকে স্প্যানিশদের হাতে স্থানান্তরিত হয়। স্প্যানিশ সরকার সক্রিয়ভাবে স্প্যানিশ লুইসিয়ানার জন্য ঔপনিবেশিকদের নিয়োগ দেয়। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্রায় ২০০০ জন মানুষ নিউ অরিলিয়েন্সের দক্ষিণে চলে আসে। এই আগতরা প্রাথমিকভাবে জেলে ছিলো। তারা বিশাল পরিমাণে চিংড়ি, কাঁকড়া এবং ঝিনুক নিউ অরলিয়েন্সের খাদ্য বাজারে সরবরাহ করতে থাকে। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ আরো নিয়ে আসে মশলা প্রধান খাবারের ভালোবাসা। এর মধ্যে ছিলো গোলমরিচের গুঁড়ো এবং লাল মরিচ ছিলো। স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ উত্তর আমেরিকার উত্তরপূর্বাঞ্চল থেকে বহিঃস্কৃত ফরাসি ভাষী আকাডিয়দের লুইজিয়ানায় বসবাসের অনুমতি দেয়। ১৭৫৫ থেকে ১৭৯৫ সালের মধ্যে প্রায় ৩০০০ অভিবাসী উত্তর আমেরিকা থেকে দক্ষিণ এবং পশ্চিম নিউ অর্লিন্স এলাকায় বসবাস শুরু করে। অচিরেই তারা কাজুন নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮০০ সালে গোপনে লুইজিয়ানা ফ্রান্সদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং ১৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র কিনে নেয়। ১৮১২ সালে নিউ অরলিয়েন্স সহ লুইজিয়ানার দক্ষিণাংশ নিয়ে লুইজিয়ানা রাজ্য গঠিত হয়।
১৮০০ সালে লুইজিয়ানার প্রায় সব কাজুন পরিবার দাস কেনে। এসব নতুন শ্রমিকেরা নতুন খাবার নিয়ে আসে যেমন আফ্রিকার সবজি ওকরা (ঢেঁড়স) এবং হাইতির ঝাল মরিচ গাছ। পেঁয়াজ এবং গোল মরিচ দীর্ঘকাল ধরেই স্প্যানিশ ও আফ্রিকার রন্ধনশৈলীর অংশ। অল্প কিছুকাল পরেই এই অঞ্চলে টমেটোর সমাবেশ ঘটে।
উৎস
[সম্পাদনা]বিশেষজ্ঞদের মতে ১৮ শতকের প্রথম দিকে লুইজিয়ানায় গাম্বোর উদ্ভব ঘটে। কিন্তু নামের ব্যাকরণ খাদ্যটির উৎস নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরী করে। উপসংহারে পোঁছানোর মত সুনির্দিষ্ট কো নিদর্শন পাওয়া যায় না কিন্তু সাংস্কৃতিক চিহ্ন বেশ কিছু বিশ্বাসযোগ্য ইঙ্গিত করে।
একটি মতে গাম্বো হচ্ছে প্রথাগত আফ্রিকান রান্নার একটি পরিশোধিত রূপ। পশ্চিম আফ্রিকানগণ বিভিন্ন খাবারের বেস হিসেবে ঢেঁড়স ব্যবহার করে। স্যুপের সাথে, মাংস এবং চিংড়ির সাথে, লবণ এবং মরিচ সহযোগে ঢেঁড়স ব্যবহার করে। লুইজিয়ানায় অন্যান্য সংস্কৃতির মানুষদের হাত ধরে বিভিন্ন উপাদান গাম্বোতে সংযুক্ত হয়েছে। ১৭৬৪ সালে আফ্রিকান দাসেরা রান্না করা ঢেঁড়সের সাথে ভাত মিশিয়ে খাবার তৈরী করতো।
গাম্বো প্রথাগত ফরাসি স্যুপ, বিশেষ করে মাছের স্টু বুইল্লাবেইসসের পরিবর্তিত রূপ হতে পারে। তীব্র শীতের সময়ে আকাডিয়রা সাধারনত সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে স্যুপ রান্না করে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি যখন আকাডিয়রা লুইজিয়ানায় চলে আসে তখন তারা নতুন জায়গায় তাদের প্রথাগত উপাদান যেমন শালগম, বাঁধাকপি পাচ্ছিলো না। এজন্য আকাডিয় কলোনি স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করা শুরু করে। মাছের বদলে শেলফিশ ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীতে আরো উপকরণ বিভিন্ন সংস্কৃতির হাত ধরে প্রবেশ করে।
২০ শতকের প্রথম দিকে কিছু রন্ধনসম্পর্কীয় বিশেষজ্ঞ যেমন সেলেস্টিন ইউস্টিস বলেন যে গাম্বো স্থানীয় উপজাতীদের উৎসবে বিশেষ খাবার হিসেবে প্রস্তুত করা হয়। এটা ১৮ শতকে প্রচলিত ছিলো। সে সময়ে অনেক কাজুনদের কাছেও ভাত খাওয়া ছিলো বিলাসিতা। ভুট্টার তৈরী খাবারের উপরে তারা গাম্বো পরিবেশন করতো। ভূট্টা এবং ফিলি গুড়োর ব্যবহার স্থানীয়দের হাত ধরেই শুরু হয়।
এইসকল তত্ব স্থানীয় কিংবদন্তি ফ্রাইং প্যান বিদ্রোহ বা পেটিকোট বিদ্রোহের সংগে মিশ্রিত হয়ে গেছে। কিংবদন্তি অনুযায়ী ১৭২২ সালে ফরাসি কলোনির নারী সদস্যেরা নিউ অরলিন্সের শাসক জ্যঁ বাপ্তিস্তে লে ময়নে সিয়েউর দে বিয়েনভিল্লে'র বাড়িতে জমায়েত হয়ে জনপ্রিয় উপাদানের ঘাটতির প্রতিবাদ করে। বিয়েনভিল্লের গৃহপরিচারিকা মাদাম ল্যাংলোইস মেয়েদের শেখান কীভাবে সাধারণ গাম্বোর উন্নতি সাধণ করা যায়। ল্যাংলোইস ঢেঁড়স ব্যবহার করেন যা দাসদের কল্যাণে মহিলাদের কাছে আগে থেকেই পরিচিত ছিলো। ল্যাংলোইস চক্তো রন্ধনশৈলীর বিভিন্ন উপাদান যেমন চাল, চিংড়ি, চিঁড়ি মাছ এবং ফিলি পাউডার ব্যবহার করেন।[৬]
উন্নয়ন
[সম্পাদনা]গাম্বো সম্পর্কিত প্রথম লিখিত সুত্রের সন্ধান পাওয়া যায় ১৯ শতকের প্রথম দিকে। ১৮০২ সালে জন সিব্লে বর্ণনা করেছেন, যে খাবারটিকে তারা গাম্বো বলে তা প্রধানত তৈরী হয় ওক্রার (ঢেঁড়স) ঘন ঝোল দিয়ে এবং ভাতের সাথে খাওয়া হয়। এটা নৈশভোজ এবং রাতের খাবারে যে কেউ খেতে পারে। পরের বছর ফরাসি গভর্নর পিয়েরে ক্লেমেন্ট ডি লাউসসাত একটি সইরের আয়োজন করেন যেখানে ২৪ ধরনের গাম্বো প্রস্তুত করা হয়। লেখক সিনথিয়া লেজেউনে নোবলসের মতে এই দুটি ঘটনা স্প্যানিশ উপনিবেশে গাম্বোর জনপ্রিয়তা ফুটে ওঠে।
১৮২৪ সালে প্রকাশিত মেরি র্যানডলফের ভার্জিনিয়া হাউজ-ওয়াইফ প্রথম রান্নার বই যেখানে গাম্বো রান্নার প্রথম রেসিপি যুক্ত করা হয়। বলা হয় পশ্চিম ভারতীয় খাবার। সাধারণ রেসিপিটি বর্ণনা করে কীভাবে ঢেঁড়স সিদ্ধ করতে হয় এবং স্টুর মত জিনিস যা গাম্বো নামে পরিচিত কীভাবে বানাতে হয়। একই বইয়ে ওকরা স্যুপ তৈরীর রেসিপি বর্ণিত হয় যা তৈরী হতো ঢেঁড়স, পেঁয়াজ, পাখি, বেকন, টমেটো, এবং ময়দা দিয়ে ঘন করা লিমা সীম। যদিও এটা গাম্বোর অনুরূপ তবে ক্যারিবিয় খাবার ক্যাল্লালুর সাথে এর বেশি সাদৃশ্য রয়েছে।
এই খাবারের আরো পরিচিত একটি সংস্করণ করা হয়েছিল ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত ম্যরিয়ন ক্যাবেল টায়ারের রান্নার বইয়ে। তার পুরান ভার্জিনিয়ার গৃহপরিচারিকা গাম্বো ফিলিত এ লা ক্রেওল ন��মে একটি খাবারের বর্ণনা করে যা ফিলি দিয়ে তৈরী গাম্বো সাথে থাকে মুরগী, ঝিনুক এবং মশলা যেমন লবঙ্গ লাল এবং কালো মরিচ, পার্সলে এবং থাইম। ১৮৮১ সালে রান্নার বই হোয়াট মিসেস ফিশারজ নোজ এবাউট সাইদার্ন কুকিং (মিসেস ফিশার দক্ষিণের রান্না সম্পর্কে কি জানেন), সাবেক দাস এবি ফিশারের নির্দেশনায় তৈরী, তিনটি গাম্বো রান্নার রেসিপি প্রকাশ করেছিলো। ঝিনুক গাম্বো স্যুপে ফিলি গুড়ো ব্যবহার করা হতো অন্যদিকে ঢেঁড়স গাম্বো এবং মুরগী গাম্বোতে ঢেঁড়স ব্যবহার করা হতো। চার বছর পরে রান্নার বই লা কুইজিন ক্রেওল আট ধরনের গাম্বোর রন্ধনপ্রণালী প্রকাশ করে। এদের কোনটিতে সসেজ ব্যবহার করা হয়, সব গুলোত হ্যাম ব্যবহার করা হয়েছে।
১৯৭০ এর দশকে পর্যন্ত গাম্বো প্রাথমিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় উপকূলে জনপ্রিয় ছিলো। মার্কিন সিনেটর অ্যালেন এল্লেন্ডারের মৃত্যুর পরে এটা বৃহত্তর পরিচিতি পায়। লুইজিয়ানার টেররেবোন প্যারিশের স্থানীয় অধিবাসী এল্লেন্ডার প্রায়শই তার সহকর্মীদের গাম্বো খাওয়াতেন যার মধ্যে পাঁচজন রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত ছিলো। এল্লেন্ডারের মৃত্যুর পরে ১৯৭২ সাল সিনেট সিদ্ধান্ত নেয় তার সম্মানে সিনেট ক্যাফটেরিয়ায় সামুদ্রিক খাবার দিয়ে তৈরী লুইজিয়ানার ক্রেওল গাম্বো যুক্ত করবে। ১৯৮০ এর দশকে গাম্বো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় যখন বাবুর্চি পল প্রুধম্মে ক্রেওল এবং কাজুন রান্নার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেন। ডিজনি চলচ্চিত্র দ্যা প্রিন্সেস এন্ড দ্যা ফ্রগ এ গাম্বোকে প্রধান খাবার হিসেবে দেখানো হয়েছে।
প্রস্তুতি এবং পরিবেশন
[সম্পাদনা]গাম্বো কমপক্ষে তিন ঘণ্টা রান্না করা হয় এবং প্রায়ই এটাকে সারাদিন ফোঁটানো হয়। মাংসকে (সামুদ্রিক খাবার নয়) প্রায়শই বাদামী বর্ণ ধারণ করলে আগুন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ঢেঁড়শ এবং রৌউক্সকে অন্যান্য সব্জি এবং সামুদ্রিক খাবারের পূর্বেই রান্না করে নেওয়া হয়। ঢেঁড়স কাঙ্ক্ষিত ঘনত্বে পৌঁছালে চুলা থেকে নামিয়ে নেওয়া হয় কিন্তু রৌউক্স তখনো পাত্রে থেকে যায়। এর পরে সসের সঙ্গে অন্যান্য মৌসুমি সবজি যোগ করা হয়। জাউয়ের মত থকথকে একটা ভাব এলে মাংস এবং ঢেড়শ যোগ করা হয় পানির সাথে অথবা পানি ছাড়াই। এর পর ঢাকনা খুলে দিয়ে মাংসের প্রত্যাশিত রঙ না আসা পর্যন্ত জ্বালানো হয়। স্বাদের জন্য মশলা যেমন লাল, কালো ও সাদা গোলমরিচ, উপসাগর পাতা, থাইম, গরম সস এবং লবণ যোগ করা হয়। নোবেলের মতানুসারে, গাম্বোতে নির্দিষ্ট মশলা যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং লুইজিয়ানায় সঠিক মাত্রায় যোগ করতে পারা একটি শিল্প। সমুদ্রজাত খাবার দ্রুত রান্না হয় তাই রান্না শেষ না হওয়া পর্যন্ত মশলা যোগ করা হয় না। গাম্বো রান্না শেষ হলে সবুজ পেয়াজ, পার্সলে কখনো কখনো এর উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সব শেষে ফিলি গুড়ো যোগ করা হয়।
ক্রেওল এবং কাজুন গাম্বো ভাতের উপর পরিবেশন করা হয় যা ফলে অনেক মানুষের খাবারটি খেতে পারে। গাম্বো জহারবেস ভাতের পাশে পরিবেশন করা হয়। গাম্বো চুলার উপরে রক্ষিত পাত্র থেকে সরাসরি পরিবেশন করা হয়। অনেক ধনী অথবা শৌখিন পরিবারে টেবিলে রক্ষিত তুরিনে খাবারটি রাখা হয়। গাম্বো এবং রুটি প্রায়শই এক সাথে খাওয়া হয় তবে অনেক কাজুন পরিবার আলুর সালাদ পরিবেশন করে। মাঝে মাঝে গাম্বো বড় মেন্যুর অংশ হিসেবে পরিবেশিত হয়।
সোনিয়াত তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের বর্ণনার পাশাপাশি ক্রেওল গাম্বোর প্রধান প্রকারভেদ গুলোর উদাহরণ দিয়েছেন।
সামাজিক দিক
[সম্পাদনা]কাজুন খাদ্যরীতিতে, সি পেইগে গুতিয়েরেজ বর্ণনা করেছেন, গাম্বো একটি অর্থনৈতিক খাবার যা অল্প কিছু মাংস বা সমুদ্রজাত খাবার দিয়ে অধিক সংখ্যক লোককে খাওয়ানো যায়। নোবেলস বলেছে, গাম্বোর বড় সুবিধা হলো বড় পাত্রে গাম্বো রান্না করলে এটা দুই থেকে তিন গুণ হয়ে যায় এবং ভিড় ভোজন করানো সম্ভব। এই রান্নায় বাবুর্চিগণ অল্প অল্প করে বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহার করতে পারে যা একক রান্নার জন্য অনুপোযোগী। বেঁচে যাওয়া মাংস এবং সমুদ্রজাত খাবার দিয়ে খুব সহজে খাবারটি তৈরী করা যায়।
১৯ শতক থেকে লুইজিয়ানার সামাজিক ভিড় তা অন্যান্য অনুষ্ঠানে গাম্বো প্রায়ই পরিবেশিত হয়ে আসছে। স্থানীয় ফেইস ডো-ডো (নাচের পার্টি) সাধারনত মধ্যরাতের শুরুতে গাম্বো পরিবেশন করে। বিভিন্ন পরিবার গাম্বোর আয়োজন করে অথবা নৈমিত্তিক সামাজিক জমায়েত হয়ে বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যরা মিলে আড্ডা দেয় ও মদ এবং গাম্বো উপভোগ করে।
দক্ষিণ লুইজিয়ানার গ্রামীণ আকাডিয়ানাতে মার্দি গ্রাস উৎযাপনের কেন্দ্রীয় আকর্ষণ হচ্ছে গাম্বো। মার্দি গ্রাসে স্থানীয় পুরুষেরা বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং কুরির দে মার্দি গ্রাস অনুষ্ঠানের জন্য গাম্বো উপকরণ প্রার্থণা করে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা নির্ধারিত স্থানে জমায়েত হয় যেখানে পুরুষেরা গাম্বো রান্না করে। রান্না শেষ হলে দলবেঁধে সবাই একসাথে খায় এবং মধ্যরাতে লেন্ট শুরু হওয়া পর্যন্ত নাচতে থাকে।
গাম্বো হচ্ছে লুইজিয়ানা রাজ্যের অফিশিয়াল খাবার। গাম্বোকে ঘিরে দক্ষিণ লুইসিয়ানায় অনেক রান্নার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এবং অনেক স্থানীয় উৎসবে এটা প্রধান আকর্ষণ থাকে।[৭] লুইজিয়ানার ব্রিজ সিটি নিজেকে বিশ্বের গাম্বো রাজধানী দাবী করে বাৎসরিক গাম্বো উৎসবের আয়োজন করে[৮] । উৎসবে একটি ঢালাই লোহার পাত্রে গাম্বো রান্না করে হয় যার গভীরতা ৩ ফুট (০.৯১ মি) গভীর ও ব্যাস ৫ ফুট (১.৫ মি)। সাধারণত উৎসবের গাম্বো পটের গভীরতা ও ব্যাস থাকে ২ ফুট (০.৬১ মি)