আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২৫ মে ১৯২৪ | (বয়স ৫৯)
জাতীয়তা | ভারতীয় |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারতীয় |
মাতৃশিক্ষায়তন | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় |
পেশা | কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য |
আন্দোলন | বাংলার নবজাগরণ |
সন্তান | শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় |
পুরস্কার | অর্ডার অফ দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার |
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (২৯ জুন ১৮৬৪ - ২৫ মে ১৯২৪)ছিলেন বাঙালি শিক্ষাবিদ, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এছাড়াও তিনি ছিলেন বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দৃঢ়চেতা মন ও মহান কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে 'বাংলার বাঘ' আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়।
জন্ম ও বংশ-পরিচয়
[সম্পাদনা]স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৮৬৪ সালের ২৯ জুন সোমবার অধুনা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী শহর কলকাতার বৌবাজারের মলঙ্গা লেনে একটি ভাড়াটিয়া বাড়িতে সেসময়ের ভবানীপুর অঞ্চলের বিখ্যাত চিকিৎসক গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও জগত্তারিণী দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।[১] এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের আদিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার জিরাট-বলাগড় গ্রামে ৷[২]
শিক্ষা
[সম্পাদনা]আগাগোড়া মেধাবী ছাত্র ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ১৮৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।[৩] তিনি ১৮৮৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ডিগ্রি ও ১৮৮৫ সালে গণিতে এম.এ পাস করেন। এর পরের বছরে তিনি পদার্থবিদ্যায় এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৮৮৪ সালে ঈশান বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৬ সালে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পি.আর.এস. অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ জ্যামিতির ওপর তার কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে।
জীবিকা ও পেশা
[সম্পাদনা]আশুতোষ মুখোপাধ্যায় স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল কলকাতা হাই কোর্টের বিচারক হওয়া। ১৮৮৮ সালে তিনি বি.এল. ডিগ্ৰী লাভ করেন এবং তখন থেকেই আইন পেশা শুরু করেন। আইন পেশার পাশাপাশি তিনি তার অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৮৮০ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে বিভিন্ন জার্নালে তিনি উচ্চতর গণিতের ওপর প্রায় কুড়িটির মতো প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স-এর সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ১৮৮৭ থেকে ১৮৯১ সালের মধ্যে তিনি গণিতের ওপর একাধিক লেকচার প্রদান করেন। তার দুটি অসাধারণ অ্যাকাডেমিক অবদান হলো ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত জিওমেট্রি অব কোণিক্স এবং ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত এল অব পারপিচুইটিস। ১৯০৮ সালে তিনি ক্যালকাটা ম্যাথামেটিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। [৪][৫] ১৮৯৪ সালে তিনি ল’ এর ওপর ডক্টরেট ডিগ্ৰী লাভ করেন এবং ১৮৯৮ সালে ট্যাগোর ল প্রফেসর হন। ১৯০৪ সালে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত কলকাতা হাই কোর্টে বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হন।
এর আগে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ও ১৮৮৯ সালে এর সিন্ডিকেটের সদস্যের পদ অলংকৃত করেন। তিনি ১৮৯৯ থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। ১৯০২ সালে লর্ড কার্জন তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৯০৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।
তার উপাচার্য হিসেবে থাকাকালীন সমগ্র সময়টি বাংলায় স্বদেশীদের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। জাতীয়তাবাদীরা সমালোচনা করে যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থায় জন সম্পদের উন্নয়ন ও জাতি গঠনের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছিল না। সতীশচন্দ্র মুখার্জীর মতে এ পুঁথিগত, কেতাবি ও অবৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা ব্রিটিশ রাজের জন্য কেবল করণিক তৈরি করছিল। ফলে ১৮৯৫ সালে সতীশচন্দ্র মুখার্জীর প্রতিষ্ঠিত ভগবত চতুস্পতি-এর মাধ্যমে শুরু হয় জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন। এটি মূলত ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে অগ্রসর হয়। ১৯০২ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি ডন সোসাইটিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯০২ থেকে ১৯০৬ সালের মধ্যে এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল হিসেবে কাজ করে।
শিক্ষাবিদ
[সম্পাদনা]কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষা জাতীয় উদ্দেশ্য লাভে ব্যর্থ হয়। ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন-এ জাতীয় শিক্ষার পরিধি আরও একটু সীমিত হয়ে যায়। কারণ এ আইনের বলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ সরকার মনোনীত ইউরোপীয়দের হাতে চলে যায়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল প্রশাসন ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে যে কোন ধরনের জাতীয়তাবাদী আদর্শের অণুপ্রবেশ বন্ধ করা। তাদের আরও চেষ্টা ছিল স্বদেশী বুদ্ধিজীবী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কলেজ সমূহকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অন্তর্ভুক্ত হতে না দেওয়া। ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে তোলে।
ঠিক এসময়ে সরকারের প্রয়োজন ছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো একজন ব্যক্তিত্ব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মপ্রচেষ্টাকে আশুতোষ সমর্থন করেন নি। তার মতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি অ্যাকাডেমিক ঐতিহ্য স্থাপন করেছে যা আমাদের রক্ষা করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত পাশ্চাত্য শিক্ষাকেও জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করা সম্ভব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার চেয়েছিলেন, বিপ্লব চান নি। সরকার অনুভব করেছিল যে, আশুতোষ মুখার্জীর তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপদ থাকবে, রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে না।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোর মধ্যে থেকেই প্রায় সব জাতীয়তাবাদমূলক বিষয়কে কার্যকর করেছিলেন। তিনি কলেজ স্ট্রীট ও রাজাবাজার ক্যাম্পাসে কলা ও বিজ্ঞান শাখার জন্য নতুন বিভাগসমূহ স্থাপন করেন এবং ‘দেশী ভাষা’ ও ‘প্রাচীন ভারতের ইতিহাস’ বিভাগ দুটি চালু করেন। বিদেশী ও ভারতীয় বহু খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ প্রফেসর হিসেবে বিভিন্ন বিভাগে নিযুক্ত হন। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত বিভাগের সিলেবাস প্রণয়নে তত্ত্বাবধান করেন। তিনি ছাত্রদের কল্যাণের জন্য যেমন উদ্বিগ্ন থাকতেন, তেমনি শিক্ষা ও পরীক্ষার ব্যাপারেও তিনি তাদের আগ্রহ সৃষ্টিতে অণুপ্রেরণা দিতেন।
পরবর্তী জীবন
[সম্পাদনা]তিনি ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো উপাচার্যের পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময়েই তিনি কলা ও বিজ্ঞান শাখার পি.জি. কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হন। ১৮৮৯ সাল থেকেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অণুপ্রেরণা। রাজনীতির সাথে জড়িত না হয়েই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ্চাত্য ও জাতীয় শিক্ষার সুফলগুলি অত্যন্ত সফলতার সাথে সংযু্ক্ত করেন। এভাবে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক রেনেসাঁস ঘটিয়ে ফেলেন।
জাতীয় শিক্ষা কাউন্সিল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় অভিষ্ঠ লক্ষ্যে তাদের কাজকর্মে কোন অংশেই পিছিয়ে ছিলনা। তবে কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অবদান বেশি রাখছিল। তখন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক প্রভাব থাকার কারণে আশুতোষ মুখার্জী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রে সম্পূর্ণ পরিবর্তন সূচিত করতে পারে নি।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৯২৩ সালে কলকাতা হাইকোর্ট ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯২৪ সালের ২৫ মে পাটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ আশুতোষের ছাত্রজীবন (অষ্টম সংস্করণ), অতুলচন্দ্র ঘটক প্রণীত , চক্রবর্ত্তী-চ্যাটার্জ্জি এন্ড কোং লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৫৪ সাল, পৃ. ৪
- ↑ আশুতোষের ছাত্রজীবন (অষ্টম সংস্করণ), অতুলচন্দ্র ঘটক প্রণীত , চক্রবর্ত্তী-চ্যাটার্জ্জি এন্ড কোং লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৫৪ সাল, পৃ. ১
- ↑ "Sir Asutosh Mukherjee: educationist, leader and institution-builder" (পিডিএফ)। currentscience.ac.in। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- ↑ Patrick Petitjean, Catherine Jami and Anne Marie Moulin eds. (1992) Science and Empires, Boston Study in the Philosophy of Science, Vol. 136, Kluwer Academic Publishers. আইএসবিএন ৯৭৮-৯৪-০১১-২৫৯৪-৯, ডিওআই:10.1007/978-94-011-2594-9
- ↑ "Calcutta Mathematical Society"। Calmathsoc.org। ৩১ মে ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুলাই ২০১২।
- ১৮৬৪-এ জন্ম
- ১৯২৪-এ মৃত্যু
- বাঙালি শিক্ষাবিদ
- ভারতীয় নাইট
- ভারতীয় বিচারপতি
- বাঙালি বিচারপতি
- বাঙালি হিন্দু
- প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- ২০শ শতাব্দীর ভারতীয় আইনজীবী
- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
- ভারতীয় বিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা
- এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি
- ২০শ শতাব্দীর ভারতীয় গণিতবিদ
- বাঙালি বিজ্ঞানী
- ২০শ শতাব্দীর বাঙালি
- ১৯শ শতাব্দীর বাঙালি
- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- বাঙালি গণিতবিদ
- ব্রাহ্ম
- কলকাতার পণ্ডিত
- ভারতের বিদ্বৎসমাজের সভ্য
- ভারতীয় গণিতবিদ
- নাইটস ব্যাচেলর
- ভারতীয় আইনজীবী
- ১৯শ শতাব্দীর ভারতীয় আইনজীবী
- রয়েল সোসাইটি অব এডিনবার্গের সভ্য
- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
- ভারতীয় শিক্ষায়তনিক
- পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষায়তনিক
- ভারতীয় বিজ্ঞানী
- ভারতীয় পণ্ডিত
- ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের প্রধান
- ভারতীয় শিক্ষায়তনিক প্রশাসক
- ভারতীয় শিক্ষাবিদ
- ভারতীয় আইনবিদ
- কলকাতা উচ্চ আদালতের বিচারক
- বাংলার ভাষাবিদ
- ১৯শ শতাব্দীর ভারতীয় গণিতবিদ
- ভারতীয় প্রভাষক
- পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাবিদ