খালেকদাদ চৌধুরী
খালেকদাদ চৌধুরী | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ১৬ অক্টোবর ১৯৮৫ | (বয়স ৭৮)
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ পর্যন্ত), পূর্ব পাকিস্তান (১৯৭১ পর্যন্ত), বর্তমান, বাংলাদেশ |
পেশা | প্রাবন্ধিক, গল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক |
পুরস্কার | বাংলা একাডেমী পুরস্কার |
খালেকদাদ চৌধুরী (২ ফেব্রুয়ারি ১৯০৭ - ১৬ অক্টোবর ১৯৮৫) একজন খ্যাতিমান বাংলাদেশী প্রাবন্ধিক, গল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক। এছাড়া তিনি ছিলেন লোকসাহিত্যের সংগ্রাহক, পত্রিকার সম্পাদক এবং একজন রাজনীতিবিদ। সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে তাঁকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক-এ ভূষিত করে।[১]
প্রাথমিক জীবন
[সম্পাদনা]খালেকদাদ চৌধুরী ১৯০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোণা জেলার মদন উপজেলার চানগাঁও গ্রামে তার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার সোনাজোড় গ্রামে। তার পিতার নাম নওয়াব আলী চৌধুরী এবং মাতা নজমুননেছা চৌধুরী। তার পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, বারভূঁঞা আমলের অন্যতম বংশাতিবংশ তারা।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলে কোম্পানি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাদের পূর্ব-পুরুষ ঢাকার গাজীপুর অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। পরবর্তিতে তাদেরই অধস্তন পুরুষ গাজী লস্কর ও গাজী আসকর নামে দুই ভাই আলাপসিং পরগনায় চলে আসেন এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। ছোটভাই গাজী আসকর নেত্রকোণা অঞ্চলের আটপাড়া থানায় সোনাজোড় গ্রামে স্থায়িভাবে বসতি গড়ে তোলেন।
খালেকদাদ চৌধুরী এই গাজী আসকরেরই অধস্তন পঞ্চম পুরুষ।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] পিতামাতার আট ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে খালেকদাদ চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। ১৯১১ সালে নাজিরগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে খালেকদাদ চৌধুরীর শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯১৬ সালে মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এর পরের বছর তিনি জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দত্ত হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৯২৪ সালে প্রথম বিভ��গে ম্যাট্রিক পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় লর্ড রিপন কলেজে ভর্তি হন। পরে কলকাতারই ইসলামিয়া কলেজে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৭ সালে অক্টোবর মাসে খালাতো বোন হামিদা চৌধুরীকে বিয়ে করে সংসারজীবন শুরু করেন। [২]
কর্মজীবন
[সম্পাদনা]বিয়ের মাত্র চার দিন পর বাবা নওয়াব আলী চৌধুরীর মৃত্যু হলে সংসারের সব দায়-দায়িত্ব তাকে নিতে হয়। সংসারের প্রয়োজনে লেখাপড়া শেষ না করেই নেত্রকোণা চলে আসেন তিনি। ১৯২৯ সালে কলকাতা মিডল্যান্ড ব্যাংকের নেত্রকোণা শাখায় সুপারভাইজার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতা করপোরেশনের একটি বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালে তিনি জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসাবে সরকারী চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত নেত্রকোণা সুনামগঞ্জ ও সিলেটে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন আদর্শ শিশুকিশোর সংগঠন নেত্রকোণা মধুমাছি কঁচি-কাঁচার মেলার পরিচালক ও আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদকের দ্বায়িত্ব পালন করেন। তিনি নেত্রকোণায় সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
সাহিত্যিক জীবন
[সম্পাদনা]ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় তিনি লেখালেখি শুরু করেন। আস্তে আস্তে ব্যাংকের কাজের চেয়ে লেখালেখিতেই তিনি বেশি আনন্দ অনুভব করেন। তার প্রথম কবিতা ছাপা হয় বিকাশ নামের একটি পত্রিয়ায়, যা প্রকাশিত হতো কলকাতা থেকে এবং এর সম্পাদক ছিলেন কবি বন্দে আলী মিয়া।[২] কবি আব্দুল কাদির ও আবুল কালাম শামসুদ্দিনের অনুপ্রেরণায় তার লেখালেখি আরও গতি পায়। স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় বাড়তি আয়ের জন্য আবুল মনসুর আহম্মদ সম্পাদিত দৈনিক কৃষক-এর কিশোর সাহিত্যপাতা ‘চাঁদের হাট’ শাহাদাত চৌধুরী ছদ্মনামে পরিচালনা করেন। তখন সবার কাছেই তিনি "মামা" নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯৪১ খ্রীস্টাব্দে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। তিনি নজরুলের সাহিত্য আড্ডাগুলোয় নিয়মিত যোগ দিতেন।[২] নজরুল সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ-এ তিনি সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি "আগুনের ফুলকি" নামে কিশোর পাতা "আতশবাজ" ছদ্মনামে পরিচালনা করেন। মাসিক সওগাত, মাসিক মোহাম্মদী, মাহে নও, দিলরুবা, যুগবাণী, সচিত্র সন্ধানী, পাকিস্তান খবর, প্রতিধ্বনি প্রভৃতি সাহিত্যপত্রে তিনি নিয়মিত লিছেন। তিনি নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক উত্তর আকাশ ও সাহিত্য সাময়িকী সৃজনী সম্পাদনা ও নিয়মিত প্রকাশ করে তখনকার নবীন লেখকদের উত্সাহিত করেন। নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, জীবন চৌধুরী, শান্তিময় বিশ্বাস, হেলাল হাফিজের মতো আরও অনেকেই তখন উত্তর আকাশ ও সৃজনী সাহিত্যপত্রিকায় লিখতেন।[২]
জীবনাবসান
[সম্পাদনা]১৯৮৫ খ্রীস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর ৭৮ বছর বয়সে এই বরেণ্য সাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে। তার মৃত্যুর পর প্রাবন্ধিক আবু জাফর শামসুদ্দিন এক নিবন্ধে লিখেন, "... সেকালের তরুণ মুসলিম সমাজে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন পূর্ণিমার চাঁদ। তাঁকে ঘিরে অসংখ্য তারকা জ্বলছিল, যার যতটুকু ক্ষমতা সেই মতো আলো বিকিরণ করছিল। একে একে সবাই বিদায় নি���্ছেন। খালেকদাদ চৌধুরীর পরলোক গমনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ তারকাটি খসে পড়লো।’ তার শেষ রচনা একটি ছোটগল্প যার শিরোনাম "আবর্ত"।
স্বীকৃতি
[সম্পাদনা]১৯৮৩ খ্রীস্টাব্দে খালেকদাদ চৌধুরীকে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়। নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, " ... আমি এক কথায় বলতে পারি, তিনি, খালেকদাদ চৌধুরী আমাদের নেত্রকোণার দর্পণ। তার উদার নেত্রের কোণায় ছায়া ফেলেছিল এই অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ। তিনি সেইসব মানুষের সংগ্রামের চিত্র এঁকেছেন সাফল্যের সঙ্গে তার উপন্যাসে, গল্পে। সেকথা আমরা তার রচনা থেকে জানি। কিন্তু নেত্রকোণার মতো আর্য-অগম্য একটি মফস্বল গ্রামে জন্মগ্রহণ করে, তিনি কীভাবে বিভাগপূর্ব কলকাতার রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক কল্লোলে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, সেখানে তার ভূমিকা কী ছিল তা আমাদের সকলের জানা ছিল না। আমাদের জন্য অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তিনি এঁকেছেন ওই সময়ের রেখাচিত্র। ফলে, নবজাগরণ প্রত্যাশী মুসলমান সমাজের পুরোধা ব্যক্তিত্ব শেরে বাংলা, কবি নজরুল, মাওলানা আকরাম খাঁ, ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, কবি আবদুল কাদির, বন্দে আলী মিয়া, কাজী আবদুল ওদুদ, কবি মহীউদ্দীন-এঁরা সবাই খালেকদাদ চৌধুরীর নেত্রকোণায় কিছুটা ভিন্নভাবে ধরা পড়েছেন।"
খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার
[সম্পাদনা]তার অবদান নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে এবং স্মৃতি রক্ষায় নেত্রকোণা সাহিত্যসমাজ ১৯৯৭ খ্রীস্টাব্দে খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করে।[৩] প্রতি বছরই পহেলা ফাল্গুনে দেশবরেণ্য একজন কবি বা সাহিত্যিককে এ পুরস্কার করে। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অধ্যাপক যতীন সরকার, কবি রফিক আজাদ, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি মহাদেব সাহা, নাট্যকার সেলিম আল-দীন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, লেখিকা রাবেয়া খাতুন, কবি হেলাল হাফিজ, সাহিত্যিক বুলবন ওসমান, কবি আবু হাসান শাহরিয়ার, কথা সহিত্যিক আনিসুল হককে খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। [৩]
প্রকাশনা
[সম্পাদনা]উপন্যাস, গল্পসংকলন, প্রবন্থ, অনুবাদ, নাটক ইত্যাদি সবমিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১৫।
- একটি আত্মার অপমৃত্যু
- রক্তাক্ত অধ্যায়
- চাঁদ বেগের গড়
- শাপ মারির অভিশাপ
- এ মাটি রক্তে রাঙ্গা
অনুবাদ গ্রন্থ হচ্ছে,
- মরু সাহারা
- বাহার-ই-স্থান-ই গায়েবী, ৪ খণ্ড, দিব্য প্রকাশ, ঢাকা।
- আল বকর দ্বীপ
- বিশ্ব সাহিত্য পরিচয়
- অভিশপ্ত মসনদ (নাটক)
- শতাব্দীর দুই দিগন্ত (আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ)।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "২০১৮ সালে একুশে পদক প্রদান"। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২৬ এপ্রিল ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-২০।
- ↑ ক খ গ ঘ বেগম, আলপনা (১৬-১০-২০০৯)। "দুই বাংলাতেই তিনি ছিলেন খ্যাতিমান লেখক"। ২০১৯-০৪-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১০-১৭। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ ক খ বেগম, আলপনা (১৬-১০-২০০৯)। "বরেণ্য সাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরী"। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১০-১৭। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য)
গ্রন্থসূত্র
[সম্পাদনা]- ইমামুর রশীদঃ খালেকদাদ চৌধুরী, বাংলা একাডেমী জীবনী গ্রন্থমালা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ১৯৯৭।
- ১৯০৭-এ জন্ম
- ১৯৮৫-এ মৃত্যু
- বাংলাদেশী সাহিত্যিক
- বাংলাদেশী কবি
- বাংলাদেশী নাট্যকার
- বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ
- নেত্রকোণা জেলার ব্যক্তি
- ২০শ শতাব্দীর বাংলাদেশী প্রাবন্ধিক
- বাংলাদেশী পুরুষ লেখক
- কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী
- বাংলাদেশী পুরুষ ঔপন্যাসিক
- বাঙালি লেখক
- একুশে পদক বিজয়ী
- সুরেন্দ্রনাথ কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- মৌলানা আজাদ কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- ২০শ শতাব্দীর বাঙালি