আহমদ শরীফ
আহমদ শরীফ | |
---|---|
জন্ম | [১] পটিয়া , চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১
মৃত্যু | ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ ঢাকা, বাংলাদেশ | (বয়স ৭৮)
পেশা | অধ্যাপক, লেখক |
ভাষা | বাংলা |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
শিক্ষা | বিএ, এমএ, পিএইচডি |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
সাহিত্য আন্দোলন | প্রথাবিরোধিতা |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার |
|
দাম্পত্যসঙ্গী | সালেহা মাহমুদ |
আহমদ শরীফ (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ - ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) একজন বাংলাদেশী ভাষাবিদ, খ্যাতনামা মনীষী এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আবির্ভূত বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অন্যতম প্রতিভূ। কলেজ অধ্যাপনার (১৯৪৫-৪৯) মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন। এক বছরের বেশি সময় রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। সেইসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অন্যতম রূপকার ছিলেন তিনি।
জন্ম ও পরিবার
[সম্পাদনা]তার জন্ম ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডীতে। পিতার নাম আব্দুল আজিজ ও মাতার নাম মিরাজ খাতুন। তার পিতা আব্দুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রামের প্রধানতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলের একজন করণিক। এ মুসলিম পরিবারের অন্দর মহলে শিক্ষার আলো ঢুকেছিল উনিশ শতকেই। তাঁর ষষ্ঠ পূর্বপুরুষ কাদের রজা সন্তানের জন্য কাজী দৌলতের সতী ময়না লোরচন্দ্রানী পুঁথিটি নিজ হাতে নকল করেছিলেন। তাঁর পিতামহ আইন উদ্দিন (১৮৪০-১৯৩৭) ছিলেন সরকারি জজ কোর্টের নকল নবিস। চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম এন্ট্রাস পাস করা এবং বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি বলে খ্যাত আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ছিলেন তাঁর কাকা ও পিতৃপ্রতিম। জন্মের পর হতে আহমদ শরীফ সাহিত্য বিশারদ ও তাঁর স্ত্রী কাছে পুত্র স্নেহে লালিত-পালিত হয়েছেন। ফলত অনেকের কাছেই তিনি সাহিত্য বিশারদের সন্তান হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁদের পিতা-পুত্রের এ সম্পর্ক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল। ১৯৪৭ সালের ৭ নভেম্বর সালেহা মাহমুদের সঙ্গে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।
শিক্ষা
[সম্পাদনা]আহমদ শরীফ ১৯৩৮ সালে পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় হতে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ হতে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক পাস করেন। পরবর্তীকালে ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২য় বিভাগে ৪র্থ স্থান অধিকার করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে "সৈয়দ সুলতান, তাঁর গ্রন্থাবলি ও তাঁর যুগ" শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
জীবিকা
[সম্পাদনা]১৯৪৪ সালে দুশ পঞ্চাশ টাকার বেতনে গ্রিভেন্সিভ অফিসার হিসেবে দুর্নীতি দমন বিভাগে চাকরি দিয়ে তার পেশাগত জীবন শুরু করেন। কিন্তু নীতিগত কারণে সেই চাকরি বেশিদিন করেননি। আসলে তার রক্তের শিরায় প্রবাহিত ছি�� শিক্ষকতার নেশা, ফলে তিনি ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাস হতে ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত লাকসামের পশ্চিম গাঁও নওয়ার ফয়জুন্নেসা কলেজে অধ্যাপনা করেন। তখন বেতন ছিল মাত্র ১১৫ টাকা। ১৯৪৮ সালে ডিসেম্বর হতে ১৯৪৯ সালের জুন পর্যন্ত ফেনী ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনায় কাটে আরো কিছুদিন। এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে যোগ দেন তিনি। চাকরির শর্ত ছিল এই যে, তিনি আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের বিশাল পুঁথির সম্ভার বিনা অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দিবেন এবং তার বিনিময়ে ঐ পুঁথি দেখভালের জন্য তাকে নিয়োগ করা হবে। এই শর্তের সূত্রেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ছাড়পত্র লাভ করেন।
১৯৫২ হতে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে বাংলা বিভাগের অস্থায়ী লেকচারার এবং ১৯৫৭ সালে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬২ সাল হতে তিনি সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপকও ছিলেন। ১৯৬৩ সাল হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সেকশনের পাশাপাশি অধ্যাপনায় যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৩ সালের ৩১ অক্টোবর চূড়ান্তভাবে অবসর গ্রহণ করেন। জীবনের ৩৬ বছরের সম্পর্ক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার। চাকরি জীবনে তিনি একাধিকবার আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ‘নজরুল অধ্যাপক পদে’ যোগ দেন এবং ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ঐ পদে কর্মরত ছিলেন।
সাহিত্যকৃতি
[সম্পাদনা]আহমদ শরীফ বড় হয়ে উঠেছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের দুর্লভ অমূল্য পুঁথির ভাণ্ডার ও সাময়িক পত্রপত্রিকার সম্ভারের মধ্যে। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি ব্যয় করেছেন মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য। যা ইতিহাসের অন্যতম দলিল। বিশ্লেষণাত্মক তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তিসমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজে ও সংস্কৃতির ইতিহাস বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর গাঁথা হয়ে থাকবে।
প্রকাশনা
[সম্পাদনা]তার লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তার প্রথম সম্পাদিত গ্রন্থ লায়লী মজনু ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এই নামে দৌলত উজির বাহরাম খানও একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মৌলিক গ্রন্থ বিচিত চিন্তা প্রকাশ হয়।
গ্রন্থতালিকা
[সম্পাদনা]- বিচিত চিন্তা
- স্বদেশ চিন্তা
- কালিক ভাবনা
- যুগ যন্ত্রণা
- বিশ শতকের বাঙালি
- স্বদেশ অন্বেষা
- মধ্যযুগের সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ
- বাংলার সুফি সাহিত্য
- বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা
- বাংলার বিপ্লবী পটভূমি
- এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপ রেখা
- নির্বাচিত প্রবন্ধ
- প্রত্যয় ও প্রত্যাশা
- বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য (দুই খণ্ড)
- সম্পাদনা
দর্শন
[সম্পাদনা]ভাববাদ, মানবতাবাদ ও মাকর্সবাদের যৌগিক সমন্বয় প্রতিফলিত হয়েছিল তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণে এবং বক্তব্য ও লেখনীতে। তার রচিত একশতের অধিক গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহে তিনি অত্যন্ত জোরালো যুক্তি দিয়ে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, বিশ্বাস ও সংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন এবং আন্তরিকভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন। পঞ্চাশ দশক হতে নব্বই দশকের শেষবধি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন ও ইতিহাসসহ প্রায় সব বিষয়ে তিনি অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। দ্রোহী সমাজ পরিবর্তনকারীদের কাছে আজো তার পুস্তকরাশির জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। তার বিশাল পুস্তকরাশির মধ্যে যেমন মানুষের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক মুক্তির কথা রয়েছে তেমনি তৎকালীন পাকিস্তানের বেড়াজাল হতে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতা তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গঠিত ‘নিউক্লিয়াস' (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ)-এর সঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯৬৫ সালে তার লেখা ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালি’ প্রবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটির কথা উল্লেখ ছিল। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব সময় হতে তার মৃত্যু অবধি তিনি দেশের সকল ক্রান্তিলগ্নে কখনো এককভাবে, কখনো সম্মিলিতভাবে তা প্রশমনের জন্য মুক্ত মনে এগিয়ে এসেছিলেন। উপমহাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অসামান্য পণ্ডিত, বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক যুক্তিবাদী, দার্শনিক, বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধির ও নির্মোহ চিন্তার এক অনন্য ধারক ছিলেন ড. আহমদ শরীফ।
মৃত্যু
[সম্পাদনা]১৯৯৫ সালে একটি উইলের মাধ্যমে তার মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করার কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। সে উইলে লেখা ছিল, ‘চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণ প্রতীক, কাজেই গোটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাইতো বাঞ্ছনীয়’। তার উইল অনুযায়ী মৃত্যুর পর তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের জন্য দান করে দেয়া হয়।
ড. আহমদ শরীফ স্মৃতি পুরস্কার
[সম্পাদনা]আহমদ শরীফ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বদেশ চিন্তা সংঘ কর্তৃক ড. আহমদ শরীফ স্মারক বক্তৃতা ও পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রতি বছর এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।[২]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Haque, Junaidul (ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১০)। "The iconoclast in Ahmed Sharif"। দ্য ডেইলি স্টার। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১১।
- ↑ http://www.thedailystar.net/story.php?nid=23201
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- ১৯২১-এ জন্ম
- ১৯৯৯-এ মৃত্যু
- ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক বিজয়ী
- প্রবন্ধ ও গবেষণায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী
- বাংলাদেশী ধর্মনিরপেক্ষবাদী
- বাংলা ভাষার লেখক
- বাঙালি লেখক
- বাংলাদেশী নাস্তিক
- চট্টগ্রাম জেলার লেখক
- বাংলাদেশী দার্শনিক
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার
- বাংলাদেশী পুরুষ লেখক
- ২০শ শতাব্দীর বাংলাদেশী দার্শনিক
- বাংলাদেশী রাজনৈতিক দার্শনিক
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
- চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- চট্টগ্রামের লেখক