বিষয়বস্তুতে চলুন

বাইবার্স

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বাইবার্স
আল মালিক আল জাহির
রুকন আল দিন
বাইবার্সের চিত্রকর্ম
মিশর এবং সিরিয়ার সুলতান
রাজত্ব২৪ অক্টোবর ১২৬০ - ১ জুলাই ১২৭৭
রাজ্যাভিষেক১২৬০ সালে সালিহিয়া মাদ্রাসায়
পূর্বসূরিসাইফুদ্দিন কুতুয
উত্তরসূরিনাসিরুদ্দিন বারাকাহ
জন্ম১৯ জুলাই ১২২৩
কিপচাক উপত্যকা [][]
মৃত্যু১ জুলাই ১২৭৭
দামেস্ক, মামলুক সালতানাত
দাম্পত্য সঙ্গীমুসাম্মাত আনতারা
বংশধরসাইদ বারাকাহ
সুলামিশ
পূর্ণ নাম
আবুল ফাতিহ মালিকুয যাহির রুকনুদ্দিন বাইবার্স বনদুকদারি
রাজবংশবাহারিয়্যা মামলুক
ধর্মসুন্নি ইসলাম

বাইবার্স বা বে-বার্স (আরবি: الملك الظاهر ركن الدين بيبرس البندقداري, মালিকুয যাহির রুকনুদ্দিন বাইবার্স বন্দুকদারি) (১৯ জুলাই ১২২৩ – ১ জুলাই ১২৭৭), ছিলেন তুর্কি কিপচাক - কুমান বংশোদ্ভূত, মালিকুল মুযাফফর সাইফুদ্দিন কুতুয এর উত্তরসূরী মিশরসিরিয়ার চতুর্থ মামলুক সুলতান। তিনি ফ্রান্সের নবম লুইয়ের নেতৃত্বে ঘোষিত সপ্তম ক্রুসেড যুদ্ধে মিশরীয় বাহিনীর একজন সেনাধ্যক্ষ ছিলেন, এবং নবম লুইকে পারিষদ সহ বন্দী করে যুদ্ধে ফলাফল নির্ধারণী ভূমিকা রাখেন। তিনি ১২৬৬ সালে আইন জালুতের যুদ্ধে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে মিশরীয় সৈন্যবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন।[] এ যুদ্ধে মোঙ্গল বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে তিনি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেন। এটি ছিলো মোঙ্গলদের জন্য প্রথম কোনো বড় যুদ্ধে পরাজয়, এতে মোঙ্গলদের মনোবল ভেঙে যায় এবং তারা অপরাজেয় বলে যে ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল তা ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়। []

বাইবার্সের সিংহাসনে আরোহণ পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মামলুক আধিপত্য বিস্তারের সূচনা বলে চিহ্নিত করা হয় এবং এরপর থেকেই তাদের সামরিক ব্যবস্থার শক্তিশালী হতে শুরু হয়। তিনি লেভান্তে ক্রুসেডারদের অস্তিত্ব নির্মূলের পথ প্রশস্ত করে মিশরসিরিয়ার সালতানাতকে এ অঞ্চলের প্রধান মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন, ক্রুসেডার এবং মোঙ্গল উভয়দিকের আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। এমনকি তিনি মাকুরিয়া রাজ্যকেও বশীভূত করেন, পূর্ববর্তী মুসলিম শাসকদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আজেয় হিসেবে বিখ্যাত ছিল। সুলতান হিসেবে বাইবার্স কুটনৈতিক এবং সামরিক কার্যক্রমে সামঞ্জস্য রাখতে জানতেন, যা মিশরীয় মামলুক সালতানাতকে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সহায়তা করে।

তার মাতৃভাষা তুর্কি ভাষায়, বাইবার্স বা বে-বার্স নামের অর্থ "মহান চিতা" বা "প্রধান চিতা"[] বা "চিতা রাজ"।[] তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডে তাঁর নামের সার্থকতা বার বার বজায় রেখে এসেছেন।

জন্ম ও শৈশবকাল

[সম্পাদনা]

সুলতান বাইবার্স ভলগা এবং উরাল নদীর মধ্যবর্তী দশথ-ই-কিপচাক/কুমেনিয়া (আজকের কাজাখস্তান) কুমেনিয়ায় ১২২৩ সালের ১৯ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন।[][][][১০][১১][১২] এই তুর্কোমানের বাল্যকাল অতটা সুখকর ছিল না। তাকে খুব অল্প বয়সে ৮০০ দিরহামের বিনিময়ে ক্রীতদাস হিসেবে দামাস্কাসে বিক্রি করে দেয়া হয়। সুলতান কুতুযের মত তাকেও মামলুক হিসেবে ক্রয় করেন আয়ুবিদ সুলতান আল-সালিহের এক সেনা কম্যান্ডার ‘আলাউদ্দিন আইতাকিন বান্দুকদার’। সে থেকেই তিনি ‘বান্দুকদারী’ উপাধিটি পেয়েছেন। এরপর তিনি দীনী শিক্ষা ও রণ-বিদ্যায় পারদর্শী হলে মিশরে সুলতান সালিহের খেদমতে প্রেরিত হন। দীর্ঘকায়, কৃষ্ণবর্ণ, নীল চোখের অধিকারী বাইবারস ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও কর্মচঞ্চল। গমগমে কন্ঠস্বরে ছিল কর্তৃত্বের সুর। এক কথায় নেতৃত্বের সব গুণই তার মধ্যে ছিল।

সিংহাসনে আরোহণ

[সম্পাদনা]

১২৫০ সালে মানসূরাহ্ এর যুদ্ধে সুলতান রুকনউদ্দীন বাইবারস ক্রুসেডের নেতৃত্ব দানকারী সম্রাট ৯ম লুই-কে স্বপারিষদে বন্দী করেন। এটা ছিল বিরাট এক সাফল্য কারণ ক্রুসেডের ইতিহাসে এই প্রথম বারের ক্রুসেডের নেতৃত্ব দানকারী কোন সম্রাটকে স্বপারিষদে বন্দী করা গেল। ক্রুসেডের নেতৃত্ব দানকারী খোদ ফ্রান্সের সম্রাট বন্দী সুলতান রুকনউদ্দীন বাইবারস এর কাছে!

সুলতান রুকনউদ্দীন বাইবারস চাইছিলেন যে সম্রাটকে মুক্তি দেওয়ার শর্ত হবে ১টাই- সেটা অল কান্ট্রি অব ত্রিপোলী মুসলিমদের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু সুলতান তুরান শাহ্ সম্রাট ৯ম লুইকে অর্থের বিনিময়ে মুক্ত করে দিলে সুলতান রুকনউদ্দীন বাইবারস এতই ক্রুদ্ধ হন যে, – সুলতান তুরান শাহকে হত্যাই করে ফেলেন। কারণ তার মতে অর্থের বিনিময়ে সম্রাট ৯ম লুইকে মুক্ত করে দেওয়া ছিল মুসলিমদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। তার অসাধারন রণনৈপূণ্যে মামলুক সালতানাত দূর্ধর্ষ বার্বার,মঙ্গোল,ক্রুসেডার এবং গুপ্তঘাতকদে হাত থেকে নিরাপদ হয়ে পরবর্তী আড়াই শত বছর পর্যন্ত টিকে ছিল।

রণাঙ্গনে বাইবার্স

[সম্পাদনা]

সুলতান হবার পূর্বেই ১২৬০ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর বাইবার্স সুলতান কুতুযের নেতৃত্বে সংগঠিত মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক আইন-জালুতের যুদ্ধে অসামান্য রণদক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। তীব্র রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী মোঙ্গলদের পরাজিত ও বিধ্বস্ত করতে সক্ষম হয়। এভাবে “মঙ্গোলদের পরাজয় অসম্ভব”- এই প্রবাদ বাক্য মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। শুধু তাই নয়, এ যুদ্ধের পরেই মঙ্গোলদের জয়রথ পুরোপুরি থমকে দাড়ায়। বাইবারসের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী দীর্ঘ ৩০০ কিলোমিটার পথ তাড়িয়ে গুটি কয়েকজন বাদে সকল হানাদার মঙ্গোল সৈন্যকে হত্যা করে যা বিশ্ব ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ যুদ্ধেই প্রথম বাইবারসের প্রবর্তিত হাত-তোপ বা হ্যান্ড-ক্যানন ব্যবহার করে মুসলিম বাহিনীী, যাকে মিদফা’ বলা হত।

আইন জালুতের যুদ্ধ কেবল মিসর ও ইসলামের ইতিহাসে নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। যদি ধ্বংসাত্মক মোঙ্গল শক্তি এ যুদ্ধে জয় লাভ করতো,তাহলে তারা উত্তর আফ্রিকা,স্পেন এবং ইউরোপের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যুগপৎ প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের ইসলামি ও খৃস্টীয় সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতো। তাই আইন জালুতের যুদ্ধে একই সঙ্গে ইসলাম ও বিশ্বসভ্যতা রক্ষা পেয়েছিল।

এদিকে আইন জালুতের চরম প্রতিশোধ নিতে সেই হালাকু খানই আবার ধেয়ে আসে মিসর-সিরিয়া পানে। মহানদী ফোরাত অতিক্রম করে তার অজেয় বাহিনী একসময় আছড়ে পড়ে মামলুক সীমান্তের অভ্যন্তরে। চোখের পলকে হিমস পর্যন্ত শামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল হালাকু খান ফের কব্জা করে নেয়। ১২৬২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ে শামের বুক চিড়ে আবারও বয়ে চললো রক্ত নদী! কিন্তু না। এবারও তাদের দম্ভ চূর্ণ করলেন দুর্ধর্ষ বীর সুলতান বাইবার্স। অবাক বিশ্ব আবার দেখলো মামলুক চমক! হালাকু বাহিনী ফের টের পেলো এতোদিন কচুকাটা করে আসা কোটি কোটি আয়েশী মুসলিম আর এই মামলুক মুসলিমরা এক নয়। সুলতান বাইবার্স প্রচণ্ড আক্রমণে তাদের পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করালেন। বাধ্য হয়ে তারা শান্তিচুক্তি করতে চাইল। চাতুর সুলতান তাদের গাদ্দারির দীর্ঘ ইতিহাস সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত ছিলেন, তাই তিনি তাদের শান্তি প্রস্তাবে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। প্রতিটি রণক্ষেত্রে তাদের পরাজিত করতে থাকলেন। ১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বীরা নামক স্থানে তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। একপর্যায়ে তারা এশিয়া মাইনরের রোম্যান সালজুক সালতানাতের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ১২৭৭ সালে মামলুকদের বিরুদ্ধে এক চূড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এলবিস্তান নামক স্থানে সংগঠিত এই যুদ্ধে সুলতান বাইবার্স শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন মঙ্গোল বাহিনী ও মিত্র সালজুক বাহিনীকে।

এছাড়াও সুলতান বাইবার্স আইন জালুত যুদ্ধে মঙ্গোলদের সাহায্যকারী ক্রুসেডারদেরকে বিশেষ করে এন্টিয়কের রাজা ষষ্ঠ বহিমন্ডকে শায়েস্তা করতে চাইলেন। এন্টিয়ক ছিল এশিয়ায় খৃস্টানদের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘাঁটি। সুলতান বাইবার্স এন্টিয়ক অবরোধের জন্য একটি বাহিনী প্রেরণ করেন এবং দীর্ঘদিন তা অবরোধ করে রাখেন। অবশেষে আর্মেনীয় রাজা হিথম তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসলে সুলতান বাইবার্স অবরোধ তুলে নেন। এরপর ১২৬৩ সালে তিনি ক্রুসেডারদের অন্যতম শক্ত দুর্গ আক্কা অবরোধ করেন। এরপর তিনি একে একে ক্রুসেডারদের সকল দুর্গগুলো গুঁড়িয়ে দিতে থাকেন। ১২৬৫ সালে ক্রুসেডারদের দখলে থাকা জেরুজালেমের নিকটবর্তী কাইসারিয়া ও হাইফা শহরদুটি জয় করেন। বিনা যুদ্ধে জাফাও দখলে নেন। এরপর ৪০ দিনের অবরোধ শেষে আরসুফও দখল করে নেন। ১২৬৬ সালে সাফেদ ও রামলা শহর দুটিও ক্রুসেডারদের দখলমুক্ত করে ফেলেন। এভাবে একের পর রাজ্য হারিয়ে ক্রুসেডাররা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে কোন কোন ক্রুসেড রাজ্য তাদের দখলে থাকা কিছু ভূখন্ড স্বেচ্ছায় সুলতান বাইবার্সকে উপহার দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে।

এবার সুলতান তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন ঔদ্ধত্য প্রদর্শনকারী ক্ষুদ্র আর্মেনীয় সম্রাজ্যের প্রতি। তিনি প্রথমে আর্মেনীয় রাজা হিথমকে আনুগত্য প্রদর্শন ও কর প্রদান করতে বলেন। কিন্তু মঙ্গোলদের চাপে সে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ফলে সুলতান বাইবার্স আমির সাইফুদ্দিন কালাউনের নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন তাকে শায়েস্তা করতে। ১২৬৬ সালে সংগঠিত রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে মামলুকদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় আর্মেনীয় বাহিনী। সিস ও আয়াস নামক দু'টি দুর্গ দখল করে মামলুক সৈন্যরা পাইকারি হারে তাদের হত্যা ও বন্দি করে এবং আর্মেনীয় সম্রাজ্যে ব্যাপক ধ্বংসাযজ্ঞ চালায়। এরপর ধীরে ধীরে এ সম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। ১২৬৮ সালে সুলতান বাইবার্স এশিয়ায় খ্রিস্টানদের দোলনা ও দুর্ভেদ্য ঘাটি খ্যাত এন্টিয়ক জয় করেন। এ সময় ১৬ হাজার ক্রুসেডারকে হত্যা এবং বন্দি করা হয় আরও ১ লাখ ক্রুসেডারকে। এন্টিয়োকের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের ছোটখাটো ক্রুসেড রাজ্যগুলিও ভেঙ্গে পড়ে। আর এভাবেই সুলতান বাইবারসের মাধ্যমে মুসলিম ভূখণ্ডগুলো থেকে স্থায়িভাবে ক্রুসেডাররা বিতাড়িত হয়, মুসলিম উম্মাহ ফিরে পায় তার হারানো গৌরব। ক্রুসেডের ইতিহাসে সুলতান বাইবার্সই সব থেকে বেশি ক্রুসেডার হত্যাকারী ও তাদের শহর ও দুর্গ ধ্বংসকারী ব্যক্তি। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অসংখ্য যুদ্ধই মূলত তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। ইসলামকে রক্ষার জন্য মোঙ্গল ও ধর্মযুদ্ধকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি ইসলামের দ্বিতীয় সালাহ উদ্দিন উপাধি লাভ করেন।

বাইবার্সের রাজত্বকালে হাসান-বিন-সাবাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গুপ্তঘাতক হাশাশিন সম্প্রদায় পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ইতঃপূর্বে হালাকু খান এ সম্প্রদায়কে ভীষণভাবে পর্যুদস্ত করলেও তাদের শক্তিকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় মিসরের জন্য হুমকি সৃষ্টি করলে তিনি তাদের মোকাবিলা করেন। ১২৭০-১২৭৩ সালের মধ্যে বাইবার্স তাদের ৯টি দুর্গই দখল করে উক্ত অঞ্চলসমূহকে তার সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। এই আক্রমণে গুপ্তঘাতকদের ক্ষমতা চিরতরে খর্ব করেন তিনি। এইভাবে যবনিকাপাত হয় ত্রাস ও ষরযন্ত্রে ভরা দীর্ঘ এক শাসনকালের। ১২৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাইবার্স নুবিয়া অধিকার করেন এবং উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকাও তার করদরাজ্যে পরিণত হয়।

আব্বাসি খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা

[সম্পাদনা]

ক্ষমতায় এসেই কায়রোতে আব্বাসীয় খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা সুলতান বাইবার্সের রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদে হালাকু খান কর্তৃক আববাসীয় বংশের শেষ খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহ নিহত হলে মুসলিম জাহান খলিফাশূন্য পয়ে পড়ে। মামলুক সুলতান বাইবার্স এই খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে মুসলিম বিশ্বের বিরাট উপকার সাধন করেন। তিনি সিরিয়া থেকে আব্বাসি বংশের এক ব্যক্তি আবুল কাসেম আহমাদ বিন মহাম্মাদ জাহের বিআমরিল্লাহকে সসম্মানে ডেকে এনে তার কাছে বাইয়াত করেন। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

শিল্প ও সংস্কারে বাইবার্স

[সম্পাদনা]

এরপর সুলতান বাইবার্স পবিত্র স্থানসমূহ সংস্কারের কাজে মনোনিবেশ করেন। প্রথমেই তিনি ঐতিহ্যবাহী আল-আজহার মসজিদের সংস্কার করেন এবং নব-উদ্যমে সেখানে লেখপড়া ও খুৎবার ব্যবস্থা করেন। অতঃপর সেখানে শাফি মাযহবের একজন প্রধান বিচারকের অধিনে প্রতিটি মাযহাবের প্রতিনিধি হিসাবে চারজন কাযীকে নিযুক্ত করেন যারা পবিত্র কোরআন ও হাদীস অনুসারে বিচার কার্য পরিচালনা করতেন। এছাড়াও মিশরের বাইরে তিনি বেশি কিছু সংস্কারমূলক কাজ করেন। এর মধ্যে রয়েছে মদিনায় মসজিদে নববীর উন্নয়ন এবং ফিলিস্থিনের আল খালিলে মাসজিদ ইবরাহিমের সংস্কার। ১২৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জেরুজালেম পরিদর্শন করেন এবং সেখানেও পবিত্র স্থানসমুহের প্রয়োজনীয় উন্নয়ন সাধন করেন। সাম্রাজ্যের মধ্যে সুন্দর সুন্দর মসজিদ তার স্থাপত্য শিল্পের প্রতি অনুরাগের পরিচয় বহন করে। মসজিদের কলি ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় ও জনহিতকর নানা প্রতিষ্ঠানও তৈরী করেছিলেন। তার আমলের স্থাপত্যের মধ্যে তার নামাংকিত মসজিদ এবং বিদ্যালয় (Al-Madrassa al-Zahiriyy) আজও বিদ্যমান। দামাস্কাসে তার সমাধিক্ষেত্রেই আজকের জাহিরিয়া পাঠাগার তৈরী হয়েছে।

মৈত্রী স্থাপনে বাইবার্স

[সম্পাদনা]

বাইবার্সের শাসনকালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মঙ্গোল এবং বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় শাসকের সঙ্গে তার মৈত্রী। সুলতান হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে তিনি যাযাবরদের একটি গোষ্ঠির প্রধান অথবা ভলগা উপত্যাকায় কিপচাকের মঙ্গোলদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী করেন। কনস্ট্যানটিনোপলের শাসক মাইকেল প্যালিওলোগাসের সঙ্গেও তার সমঝোতা হয়। লাতিন খ্রিস্টানদের কট্টর বিরোধী প্যালিওলোগাস তার শহরে ক্রুসেডারদের হাতে বিধ্বস্ত প্রাচীন মসজিদের পুননির্মাণের নির্দেশ দেন। তারই অনুরোধে এই কাজ তদারকের জন্য সুলতান বাইবার্স একজন মালিকী মতবাদের নেতাকে কনস্ট্যান্টিনোপল পাঠান। নবম লুইয়ের ভ্রাতা ও সিসিলির রাজা আনজাউ-এর চালসের সনহে বাইবার্সের বাণিজ্যিক চুক্তি হয়। বাণিজ্যিক চুক্তি হয় আরাগনের জেমস এবং সেভিলের আলফন্সোর সঙ্গেও।

মঙ্গোলদের ইসলামের পথে নিয়ে আসার ব্যাপারে তার ভূমিকা প্রধান। তিনি মঙ্গোলদের সাথে গোল্ডেন হোর্ড-এ (ততকালীন মঙ্গোল-তাতার সাম্রাজ্য) মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং তাদের মিশর পরিভ্রমণের ব্যবস্থা নেন। মিশরের সাথে যোগাযোগের ফলে বিপুল সংখ্যক মঙ্গোল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি সিংহলের সহিত দূত বিনিময় করেন এবং দূরপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া তিনি কনস্টান্টিনোপল, সিসিলি, আরাগণ ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তার বৈদেশিক নীতির ফলে মামলুক সাম্রাজ্যের গৌরব বৃদ্ধি পায়। বাইবার্স একজন বিচক্ষণ-ন্যায়পরায়ণ শাসনকর্তা ছিলেন। অনুগত প্রজাদের প্রতি তিনি ছিলেন দয়াশীল। কিন্তু অবাধ্য আমীরদের তিনি কঠোর শাস্তি দিতে দ্বিধা করেননি। তিনি তার রাজ্যে মদ,জুয়া প্রভৃতি অনৈসলামিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করেন। বাইবার্স একজন ধর্মপ্রাণ সুন্নী মুসলমান ছিলেন। তিনি একটি আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন।

সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানে অবদান

[সম্পাদনা]

সাম্রাজ্যে নানা প্রকার জনহিতকর কাজের পাশাপাশি তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের একজন অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক আবু-আল-হাসান আলী ইবনে-আল-নাফিস এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক যিনি ফুসফুসে রক্ত চলাচল সম্পর্কে স্পস্ট ধারণার কথা জানিয়েছেন। অথচ এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয় স্পেনের সারভেটাসকে যার তত্ত্ব রচিত আলী-ইবনে নাফিসের ২৫০ বছর পরে। সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম জীবনী রচয়িতাদের অন্যতম ইবনে-খাল্লিকান (খ্রিঃ ১২১১-৮২) তার সময়েই রচনা করেন ‘ওফাইয়াত-উল-আ- ইয়ান ওয়া আনবা-উজ-জামান’ শিরোনামের একটি জীবনীমূলক অভিধান গ্রন্থ যাকে নিকলসন সর্বোৎকৃষ্ট জীবনীগ্রন্ত বলেছেন। তার জীবনী ‘সিরাত আল-জাহির বাইবার্স’ (Life of al-Zahir Baibars) হল একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় আরবীয় সাহিত্য যেখানে রচিত আছে তার যুদ্ধ জয় অর্জনের কথা। কাজাখস্তান, মিশর সিরিয়াতে তিনি বীরের মর্যাদা পান।

সাহিত্যেকর্মে সুলতান বাইবার্স

[সম্পাদনা]
  • Robert E. Howard রচিত "The Sowers of the Thunder” এর মূলনায়ক বাইবার্স
  • রাশিয়া-কাজাখ লেখক Moris Simashko (Moris Davidovich Shamas) রচিত উপন্যাস "Yemshan" তে তিনিই প্রধান চরিত্র
  • Robyn Young এর রচনা Brethren and Crusade এর অন্যতম প্রধান চরিত্র বাইবার্স
  • Jefferson Cooper's (Gardner Fox) এর উপন্যাস “The Swordsman” এর প্রধান চরিত্র তিনি
  • Harold Lamb এর মতে আরব্য রজনীর ‘Haroun of Baghdad’ আসলে Baibars of Cairo। কারণ পি কে হিট্টির মতে, মামলুক সুলতানদের আমলেই ‘আরব্য রজনী, চূড়ান্ত রুপ ধারণ করে।
  • লেবানিজ-আমেরিকান লেখক Rabih Alameddine এর “Hakawati” বইয়ের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র বাইবার্স।
    • লেখক Peter Berling এর The Children of the Grail বইয়ের অন্যতম চরিত্র বাইবার্স
  • কাজাখ ন্যাশনাল সিনেমা স্টুডিও “কাজাখ ফিল্ম” ১৯৮৯ সালে Sultan Beybars নামে একটা সিনেমা বানায়।
  • ঐতিহাসিক Muazam Javed Bukhari সুলতানের রিয়েল বায়োগ্রাফি রচনা করেন যার নাম “Qahira ka Qaher” (A Warrior of Egypt)

মৃত্যু

[সম্পাদনা]

১৭ বছরের দীর্ঘ শাসন শেষে ১২৭৭ সালের ১লা জুলাই মৃত্যু বরণ করেন। তাকে দামেসকের জাহিরিয়া পাঠাগারের পাশে দাফন করা হয়।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Adventuring in the Englishes: Language and Literature in a Postcolonial Globalized World, Ikram Ahmed Elsherif, Piers Michael Smith. 2014. Part I; Chapter 2, pg 18.
  2. "Baybars I"Britannica 
  3. The New Encyclopædia Britannica, Macropædia, H.H. Berton Publisher, 1973–1974, p.773/vol.2
  4. The history of the Mongol conquests, By J. J. Saunders, pg. 115
  5. Heghnar Zeitlian Watenpaugh (২০০৪)। The image of an Ottoman city: imperial architecture and urban experience in Aleppo in the 16th and 17th centuries। Brill। পৃষ্ঠা 198। আইএসবিএন 90-04-12454-3 
  6. Caroline Williams (২০০৮)। Islamic Monuments in Cairo: The Practical Guide; New Revised Edition। The American University in Cairo Press। পৃষ্ঠা 185। আইএসবিএন 9789774162053 
  7. Al-Maqrizi, from the Berish tribe that currently lives in the Western part of Kazakhstan, Al Selouk Leme'refatt Dewall al-Melouk, p.520/vol.1
  8. Ibn Taghri, al-Nujum al-Zahirah Fi Milook Misr wa al-Qahirah, Year 675H /vol.7
  9. Abu al-Fida, The Concise History of Humanity, Tarikh Abu al-Fida pp.71-87/ year 676H
  10. Ibn Iyas , Badai Alzuhur Fi Wakayi Alduhur, abridged and edited by Dr. M. Aljayar, Almisriya Lilkitab, Cairo 2007, আইএসবিএন ৯৭৭-৪১৯-৬২৩-৬ , p.91
  11. Baibars in Concise Britannica Online, web page
  12. Brief Article in Columbia Encyclopedia, web page ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২২ এপ্রিল ২০০৪ তারিখে