পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: নবম খণ্ড
৮০

॥ প্রথম বাংলাদেশ সরকার॥

 ৪ঠা এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের পতন ঘঠলে পাকিস্তানীরা ক্রমান্বয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১০ই এপ্রিলের মধ্যে সেতুর নিকট তারা তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তোলে। এই সময় শত্ররা ছিলো আক্রমণমুখী এবং আমাদের ভুমিকা ছিলো আত্মরক্ষামূলক। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী আত্মরক্ষমূলক অবস্থানে থাকতে থাকতে আমাদের সৈন্যরা উদ্যম হারিয়ে ফেলছিলো।

 ১১ই এপ্রিল সকাল ৮টায় শত্রুপক্ষের গোলন্দাজ বাহিনী কালুরঘাট অবস্থানের ওপর আক্রমন শুরু করে। নৌ-বাহিনীর কামানগুলো থেকেও গোলাবর্ষণ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন হারুন এবং লেফটেন্যাণ্ট শমসের সেতুর পশ্চিম পার্শ্বে (শহরের দিকে) অগ্রবর্তী দলের নেতৃত্বে ছিলেন। আমাদের প্রধান অবস্থান ছিলো সেতুর পূর্ব পার্শ্বে।

 কিছুক্ষণের মধ্যে শত্রুদের গোলাবর্ষণ তীব্রতর হয়ে ওঠে। এই গোলাবর্ষনের ছত্রছায়ায় পাকিস্তানীরা সম্মুখযুদ্ধেও প্রস্তুতি নিয়ে সেতুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ট্রেঞ্চ থেকে হারুন শত্রুপক্ষের অস্বাভাবিক তৎপরতা লক্ষ্য করে শমসেরকে বলল তোমার বাইনোকুলারটা দাও তো। ওদের অবস্থানটা দেখি। কথা শেষ না হতেই হারুন তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করল। তীব্র যন্ত্রনায় হারুন কুকড়ে যাচ্ছিলো। লাইট মেশিনগানের এক ঝাক গুলি তাকে বিদ্ধ করেছে। দুজন ছাত্র তাড়াতারি হারুনকে ধরে সেতুর গোড়ায় নিয়ে এলে সে নিজেই প্রায় দৌড়ে সেতু পার হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে যায়। তাকে একটি মাইক্রোবাসে পটিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর অল্পক্ষন পরেই শমসেরের হাটুতে গুলি লাগলে সেও অচল হয়ে পড়ে। তখন তার প্রায় চারপাশেই লড়াই চলছিলো। শমসের শত্রুদের হাতে বন্দি হয়। দুজন অফিসারকে হারিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। তারা ঘাঁটি ত্যাগ করে পিছনে হটতে শুরু করে। সেদিন বিকাল নাগাদ কালুরঘাটে অমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং আমাদের সৈন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পথ ধরে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হ���ে থাকে।

 পথে মহালছড়িতে হঠাৎ পাকিস্তান বাহিনীর কমাণ্ডো কোম্পানীর সাথে তাদের সংঘর্ষ বেধে যায়। পাক বাহিনীর সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী মিজোরাও ছিল। পাকিস্তান সরকার এইসব মিজোদের আশ্রয় এবং ট্রেনিং দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক তৎপরতায় সহায়তা করতো।

 উদালিয়া চা বাগানে আমাদের যে কোম্পানী ঘাঁটি স্থাপন করেছিলো পাকিস্তানীদের তীব্র আক্রমণে তাদের সে এলাকা পরিত্যাগ করতে হয়। ওদিকে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের কুমিরায় তখন প্রচণ্ড লড়াই চলছিলো। চট্টগ্রামের দিকে শত্রুও অগ্রাভিযান প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের যে সৈন্যরা সেখানে অবস্থান গ্রহন করেছিলো শত্রু বাহিনী পর্যবেক্ষণ বিমানের সহযোগিতায় তাদের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। গোলাবর্ষণে আমাদের পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আরো রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য আমাদের সৈন্যরা সীতাকুণ্ডুতে সরে আসে। শত্রু সৈন্যের আগমন বিলম্বিত করার উদ্দেশ্যেই সেখানে আমাদের অল্প কয়েকজন সৈন্য থেকে যায় এবং এই অবসরে বাঙালী সৈন্যরা তাদের সীতাকুণ্ডু ঘাটি সুদৃঢ় করে গড়ে তোলে। কিন্তু ১৬ই এপ্রিলের মধ্যে শত্রুরা আমাদের সীতাকুণ্ডু অবস্থানের ওপর আঘাত হানে। তারা গোলান্দাজ বাহিনীর সহায়তায় কয়েক দফা হামলা চালায়। নৌ-বাহিনীর কামানগুলো তখন ব্যাপক ভাবে গোলাবর্ষণ করছিলো। তবুও আমাদের সেনারা পাল্টা আঘাত হেনে শত্রুপক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে।

 বাংলাদেশে প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখন ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময়ে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় আমবাগানে বাঙালীর জীবনে এক অনন্য সাধারণ ঘটনা ঘটে যায়। দিনটি ছিল এপ্রিলের ১৭ তারিখ। ঐদিন সকাল আনুমানিক ৮টায় জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্ণেল (অবঃ) এম,এ,জি ওসমানী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা বৈদ্যনাথ তলা এসে পৌঁছান। নেতৃবর্গের বসার জন্য